spot_img

জীবন বাঁচাতে জনপ্রিয় হচ্ছে ‘ভেগান’ ডায়েট

অবশ্যই পরুন

আমাদের লাইফস্টাইল দিনে দিনে এমন হচ্ছে যে- ফাস্ট ফুড ও চর্বিযুক্ত খাবারের দিকে আমরা খুব বেশি ঝুঁকে পড়ছি। ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যান্সারের মত কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতন হলেই নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই সুস্থ জীবন পেতে খাদ্যাভাসে আনতে হবে পরিবর্তন, হতে হবে খাদ্য সচেতন। এ ক্ষেত্রে ‘ভেজিটেরিয়ান’ বা ‘নিরামিষ ভোজী’ হলে দীর্ঘদিন রোগহীন থাকা সম্ভব। আর এই সূত্র লুফে নিয়েছেন বিশ্বের অসংখ্য মানুষ। অনেকেই খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনে হয়েগেছেন ‘ভেগান’।

‘ভেজিটেরিয়ান’ বা ‘নিরামিষ ভোজী’-এ বিষয়টির সঙ্গে আমরা কম বেশি পরিচিত। কিন্তু ইদানিং সারা বিশ্বে আরও একটি খাদ্যাভ্যাসের প্রচলন শুরু হয়েছে। দিনে দিনে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে খাদ্যাভ্যাসটি। এর নাম হচ্ছে ‘ভেগান’। মূলত, ভেজিটেরিয়ান (vegetarian) শব্দটির প্রথম তিনটি ও শেষ দুটি অক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে ভেগান (vegan)। সহজভাবে এর অর্থ যদি বলি তা হবে ‘উদ্ভিদভোজী’।

সাধারণত নিরামিষাশীদের খাদ্য তালিকায় কোনো প্রকার প্রাণীর মাংস থাকে না। আর একজন ভেগান শুধু মাংস নয়- পোল্ট্রি, মাছ, দুগ্ধজাতীয় খাবার, ডিম ও মধু— এসবের কোনো কিছুই খান না। অর্থাৎ ভেগানরা ভেজিটেরিয়ানদের মধ্যেও আরো অনেক বেশি কট্টর। এমনকি তারা পশুর চামড়া, ওল বোনা ও মুক্তার ব্যবহারকেও সমালোচনার চোখে দেখেন। ভেগানরা মূলত শাক-সবজি ও ফল-মূল জাতীয় খাদ্যই রাখেন তাদের খাদ্য তালিকায়।

খাদ্য তালিকায় মাংস না থাকাটা নতুন কিছু নয়। আজ থেকে আড়াই হাজারেরও বেশি (২৫০০) সময় আগে প্রাচীন ভারতে এই চর্চা ছিল। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেও এমন প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।

গণিত শাস্ত্রবিদ পিথাগোরাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক নাগরিক। তিনি সকল প্রাণীর প্রতি মমত্ব ও দয়া প্রদর্শনের পক্ষে বলেছেন। কারণ তিনিও ছিলেন একজন ‘ভেগান’ বা নিরামিষাশী। যিনি খ্রিস্টের জন্মের ৫শ’ বছর আগে জীবিত ছিলেন।

‘ভেজিটেরিয়ান’ ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠার আগে প্রচলন ছিল ‘পিথাগোরিয়ান ডায়েট’-এর। অর্থাৎ যারা খাদ্য তালিকায় মাংস পরিহার করত তাদেরই তখন বলা হতো ‘পিথাগোরিয়ান ডায়েট’ মেনে চলা মানুষ।

১৯৪৪ সালে যুক্তরাজ্যের ডাল্টন ওয়াটসন প্রতিষ্ঠা করেন ভেগান সোসাইটি। মূলত তিনিই ‘ভেগান’ শব্দটির প্রচলন ঘটান। প্রাণীর প্রতি প্রেম এবং সেই সাথে নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ‘ভেগান’ হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। তাইতো সারা বিশ্বে ১ নভেম্বর পালন করা হয়- ‘বিশ্ব ভেগান দিবস’।

এতো গেলো ‘ভেগান’র ইতিহাস। এবার জেনে নেওয়া যাক কি কারণে এটি খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে-

মূলত যারা পশুপ্রেমী, পরিবেশবাদী এবং ধার্মিক, তারাই ভেগান ডায়েট মেনে চলেন। তবে অনেকে ভেগান হয়ে যান কারণ তারা মনে করেন এই খাদ্যাভ্যাসটি স্বাস্থ্যকর। গবেষণাও বলে, ভেগান হওয়াটা স্বাস্থ্যকর। ইদানিং দেখা গেছে অনেক মানুষই নিরামিষ আহারী হয়ে উঠছেন। তাদের দাবি- এটি তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করবে।

যুক্তরাজ্যে এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৪৯ ভাগ মানুষ তাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্য তালিকায় মাংস না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কারণ গরুর মাংস ও প্রক্রিয়াজাতকরণকৃত কৌটার মাংস খেলে অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। সাম্প্রতিক অনেক গবেষণাতেই এ তথ্য উঠে এসেছে।

অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে- নিরামিষাশী হয়ে গেলে কি সত্যি-সত্যি স্বাস্থ্যের কোনো উপকার হবে?

এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিচ্ছি-

একজন ব্যক্তি দফায় দফায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, হার্ট ব্লক হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাকে সুস্থ রাখতে ব্লক হওয়া হার্টে চিকিৎসকও বেশ কয়েকটি রিং পড়িয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন অবস্থানে পৌঁছেছে যে, আর রিং পড়িয়ে বা চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ রাখা সম্ভব না। তার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনে সুস্থ থাকা সম্ভব। আর এটি সম্ভব ‘ভেগান’দের পক্ষেই।

সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় জানা গেছে যে, হ্যাঁ, ভেগান হলে স্বাস্থ্যের সত্যিই উপকার হয়। মাংস বা ডেয়ারি দ্রব্য না খেলে স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয় না, বরং আরও বেশি সুস্থ ভাবে বাঁচা যায়, সেই সঙ্গে কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে নিজেকে সামিল করা যায়। তবে এটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, ভেগান হলেই কেউ দীর্ঘ জীবন পাবে।

মনে রাখতে হবে- নিয়ম ছাড়া হঠাৎ করেই এই খাদ্যাভ্যাস বা ডায়েট শুরু করলে বিপদ আছে। কারণ ভেগান হতে হলে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। যারা সারা জীবন মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার বেশি বেশি খেয়ে কাটিয়েছেন, হুট করে ভেগান হয়ে গেলে তারা বিপদে পড়তে পারেন।

কিভাবে হয়ে উঠবেন ভেগান-

প্রথম কয়েক সপ্তাহ :

প্রথম প্রথম মাংস কম খাওয়া। ফল-সবজি বেশি খাওয়া। এর কারণে অনেকেরই এনার্জি বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবার বেশি খাওয়ার কারণে শরীর ভালো লাগতে থাকে। ফাইবার বেশি খাওয়ার কারণে মলত্যাগের রুটিন নিয়মিত হয়ে আসতে পারে। তবে এর পাশাপাশি পেট ফাঁপা, গ্যাস এবং লুজ মোশনের সমস্যাও হতে পারে একই কারণে। এমনকি অনেকের ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস দেখা দিতে পারে। কিছু সময় পরে অবশ্য পেটের সমস্যাগুলো চলে যেতে পারে।

তিন থেকে ছয় মাস পর :

কয়েক মাস টানা ফল ও সবজি বেশি খাওয়ার কারণে অনেকেরই ত্বক সুন্দর হয়ে যায়। ব্রণ দূর হয়ে যায় এবং দাগ কমে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে অনেকেই ভিটামিন ডি এর অভাবে ভুগতে পারেন, কারণ এই ভিটামিনটি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাংস, মাছ এবং দুগ্ধজাত খাবার থেকে পাই। ভিটামিনটির অভাব সহজে বোঝা যায় না। তা আমাদের হাড়, দাঁত ও পেশী শক্তিশালী রাখে। এর অভাবে ক্যন্সার হৃদরোগ, মাইগ্রেন এবং ডিপ্রেশন দেখা দেয়। শরীরে এই ভিটামিন ২ মাস জমা থাকে। এর পরেও সূর্যের আলো থেকে শরীর কিছু পরিমাণে ভিটামিন ডি তৈরি করতে পারে। ভিটামিন ডি ফর্টিফাইড খাবার যেমন জুস ও কর্নফ্লেক্স গ্রহণ করতে পারেন, বা ট্যাবলেট খেতে পারেন।

তিন থেকে ছয় মাসের মাঝে ভেগান ডায়েট হৃদস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এতে কমে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।

তবে কারও কারও আয়রন, জিঙ্ক এবং ক্যালসিয়াম ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তারা এসব খনিজের ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল গ্রহণ করতে পারেন।

ছয় মাস থেকে কয়েক বছর পর :

প্রায় বছরখানেক ভেগান খাবার খাওয়ার পর শরীরে ভিটামিন বি১২ এর মজুদ কমে আসতে পারে। এই ভিটামিন রক্ত এবং স্নায়ু কোষের জন্য জরুরী, আর তা শুধুমাত্র প্রাণীজ খাদ্য থেকেই পাওয়া সম্ভব। বি১২ ঘাটতির লক্ষণ হলো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ক্লান্তি, স্মৃতিশক্তির অবনতি এবং হাত ও পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরা।  ভিটামিন বি১২ ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খেলে এই সমস্যা এড়ানো যেতে পারে।

কয়েক বছরের মাঝে আরও কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও দেখা দিতে পারে।  ব্রকোলির মতো খাবার যাতে ক্যালসিয়াম বেশি আছে, এগুলো খাওয়া উচিৎ।

ভারসাম্য বজায় রাখুন :

চিরকালের মতো প্রাণীজ খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।  ভেগান ডায়েট থেকে অনেক উপকার পাওয়া যায় সত্যি। কিন্তু বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজের ঘাটতি হলে এসব উপকারের বদলে ক্ষতিই হবে বেশি।

সংবেদনশীল হতে হবে :

হামবুর্গ শহরের ভোক্তা সুরক্ষা কেন্দ্রের প্রধান সিলকে শোয়ার্টাউ বলেন, ‘ভেগান হতে হলে নিজের খাবারের ব্যাপারে সংবেদনশীল হতে হবে।’

ভেগান হলে উপকার :

অদ্ভুত রকমভাবে লক্ষ্য করা গেছে যে, পৃথিবীতে ভেগানিজমের দিকে যেমন আগ্রহ বাড়ছে তেমনি আবার মাংস ভোগ করার পরিমাণও বেড়েছে। চীন ও ভারতের মতন দেশ, যাদের অনেক জনসংখ্যা আছে এবং যারা দ্রুত উন্নতির দিকে যাচ্ছে তাদের মধ্যে দেখা গেছে যে, মাংস ভোগের প্রবণতা ক্রমশই বেড়েছে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন জানিয়েছে, পৃথিবীর বর্ধিত জনসংখ্যা এবং ধরিত্রীর প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে ভীষণ চাপ বাড়ার কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ সংকট দেখা দিতে পারে। তবে, যদি টেকসই উপায়ে আরো ৭০ ভাগ বেশি খাদ্য উৎপাদন করত পারে তবে, এই সংকট এড়ানো সম্ভব।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, মাংসের যোগান বাড়াতে খামারে যে ব্যাপক সংখ্যক গবাদি-পশু পালন হয় এতে করে প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। আর এই গ্যাস জলবায়ুর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৭০০ কোটি। কিন্তু ২০৫০ সাল নাগাদ তা বেড়ে হবে প্রায় সাড়ে ৯০০ কোটি। এই জনবহুল পৃথিবীতে মাংস বাদ দিয়ে নিরামিষাশী হওয়াকে দায়িত্বশীল খাদ্যাভ্যাস বলে ব্যাখ্যা করছেন ভেগানরা।

সর্বশেষ সংবাদ

আগামীতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যেন কোনো রাজনীতি না হয়: ক্রীড়া উপদেষ্টা

রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনে চিকিৎসকদেরও পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আজ শনিবার (২৩...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ