ছোট্ট একটি আরব দেশ কুয়েত, ৯টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। পশ্চিম এশিয়ার এ দেশটির অবস্থান আরবের উত্তরাঞ্চলে, পারস্য উপসাগরের প্রান্তে। ইরাক ও সৌদি আরবের সঙ্গে এর সীমান্ত রয়েছে। এ দেশটি স্টেট অফ কুয়েত নামেও পরিচিত। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশের কাছে থেকে স্বাধীনতা পায় কুয়েত।
২০১৬ সালের হিসাব অনুসারে কুয়েতের মোট জনসংখ্যা ৪৩ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে কুয়েতি ১৩ লাখ, আর বিদেশি ৩০ লাখ। অর্থাৎ কুয়েতের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই বিদেশি।
কুয়েতে প্রথম তেলের খনি পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। দেশটিতে ১৯৪৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়। কুয়েতের ৯০ ভাগ আয় আসে তেল থেকেই। বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কুয়েত অত্যন্ত শক্তিশালী। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ তেলের মজুদ রয়েছে দেশটিতে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রার মধ্যে কুয়েতি দিনার অন্যতম। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থান তাদের। এখানকার মুদ্রার মান পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ কোটিপতি।
কুয়েত পৃথিবীতে একমাত্র দেশ যেখানে গরমের কারণে জাতীয় দিবস পাল্টাতে হয়েছে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ১ জুন জাতীয় দিবস পালন করত। ১৯৬২ পর ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবস পালন করা হয়। কুয়েতের অফিসিয়াল ভাষা আরবি। এখানে ভোটের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠিত হয়। ২০০৫ সাল থেকে কুয়েতে নারীদের নির্বাচন লড়ার অধিকার সুনিশ্চিত হয়। বিশ্বের পঞ্চম তেল ভাণ্ডার কুয়েতের আছে।
এখানকার মিডিয়াকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া আছে। কুয়েতে প্রাকৃতিক পানি নেই। এ কারণে কুয়েতে অপরিশোধিত পানিকে ওয়াটার ডি নাইজেশান পদ্ধতিতে পান করার উপযোগী করা হয়। কুয়েতে আজানের সময় নাচ, গান, খাওয়া দাওয়া সমস্ত কিছু নিষিদ্ধ। কুয়েতে ঈগল সব যায়গায় দেখা যায়। তাই এখানকার মুদ্রাতেও ঈগলের ছবি আছে। কুয়েতে চাষবাস হয় না বললেই চলে। কারণ মাত্র ১ ভাগ চাষ যোগ্য জমি আছে কুয়েতে। ৪২ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কুয়েতের জিডিপি ৭২০০০ ডলার। কুয়েতের রাজধানীতে ৪ লাখ মানুষ বসবাস করে।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় অপেরা হাউসের অবস্থান এই দেশটিতে। এ কারণে কুয়েতকে ‘উপসাগরের হলিউড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
গত শতকের আশির দশকে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। শেয়ারবাজারে ধস নামায় শুরু হয় অর্থনৈতিক সঙ্কট। ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করে ইরাক। আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর হস্তক্ষেপের পর ১৯৯১ সালে এই দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অর্থনীতি ও দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনে জোর তৎপরতা শুরু হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র কুয়েত। বিবিসির বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, কুয়েত দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বের একটি মিত্র দেশ। তেলসমৃদ্ধ এই দেশটি নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল এবং বড় প্রতিবেশী ইরাকের হাত থেকে দেশটিকে রক্ষার জন্য ব্রিটেন ১৯৬১ সালে সৈন্য পাঠিয়েছিল।
এর পর ১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত দখল করে নেবার পর মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনী ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামে সেনা অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীকে সরিয়ে দেয়।
কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ ৯১ বছর বয়সে মারা যান। এরপরই দেশটির মন্ত্রিসভা তার সৎভাই ৮৩ বছর বয়স্ক শেখ নওয়াফ আল-আহমেদকে নতুন আমির বলে ঘোষণা করে।
শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ জুলাই মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার অসুস্থতা কী ছিল- তা প্রকাশ করা হয়নি।
শেখ সাবাহ আল-আহমেদ আল-সাবাহ ২০০৬ সাল থেকে কুয়েতের আমির ছিলেন। এর আগে ৫০ বছর ধরে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির তত্ত্বাবধান করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতির ক্ষেত্রে তার সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাকে ‘ডিন অব আরব ডিপ্লোম্যাসি’ বলা হতো।
দেশটি দীর্ঘ দিন ধরেই আল-সাবাহ পরিবারের বয়স্ক শাসকদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে এলেও আরব বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় কুয়েতে রাজনীতি অনেক প্রাণবন্ত।
এখানে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা অবাধে সাবাহ পরিবারের সমালোচনা করতে পারেন, সরকারের মন্ত্রীদের জবাবদিহি করতে পারেন, এবং এ কারণে কখনো কখনো রাজনীতিতে অচলাবস্থাও সৃষ্টি হয়েছে।
তবে সাবাহ পরিবার সরকার ও নির্বাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে, এবং রাজনৈতিক বিষয়ে আমিরের মতই শেষ কথা।
তাছাড়া পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া ও নির্বাচন দেবার ক্ষমতাও রয়েছে আমিরের হাতে।
কুয়েতের শাসকরা ধর্মীয় রক্ষণশীলতার মোকাবিলা করে নারীদের ভোটাধিকার এবং রাজনৈতিক পদে আসীন হবার পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন।
কুয়েতকে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের এমন একটি শক্তি হিসেবে দেখা হয় – যারা মধ্যস্থতার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করতে ভূমিকা রেখেছে।
আর এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে পরলোকগত আমিরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।