গত বছরের জানুয়ারিতে ঝং শানশান চীনের অন্যতম এক বিলিয়নিয়ার ছিলেন। মোট সম্পদমূল্য ছিল ৭শ’ কোটি ডলার। কিন্তু, ভাগ্য সহায় হলে বরাত খুলতে কতক্ষণ! আর সঙ্গে যদি থাকে অধ্যাবসায়। তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে গেল বছরে হু হু করে বাড়তে থাকে শানশানের সম্পদ। বছরের শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগেই তিনি পরিণত হন বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বে।
এরপর সেপ্টেম্বরের শেষে চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত ধনী আলিবাবার মুখ্য নির্বাহী জ্যাক মা’কে পেছনে ফেলে দেশটির শীর্ষ ধনী হলে আরেকবার সংবাদের শিরোনাম হন তিনি। আর ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ৬৬ বছর বয়সী ঝং শানশানের সম্পদ বাড়ে আগের চাইতে ১৭শ’ কোটি ডলার। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন সমগ্র এশিয়ার এক নম্বর বিত্তশালী।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, চলতি জানুয়ারির শুরুতে ঝং এর মোট সম্পদ ছিল ৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা এখন কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৭.৪ বিলিয়ন ডলারে। মাত্র কয়েকশ’ কোটি ডলার কম নিয়ে তিনি বিশ্বের ষষ্ঠ ধনী ওয়ারেন বাফেটের চাইতে কিছুটা পিছিয়ে।
তার সম্পদে বাড়বাড়ন্ত প্রধানত দুটি কোম্পানির কারণে; একটি হলো বোতলজাত পানি বিক্রেতা নোংফু স্প্রিংস এবং অন্যটি টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা- বেইজিং ওয়ানতাই বায়োলজিক্যাল ফার্মেসি এন্টারপ্রাইজ। দুটি কোম্পানিরই চেয়ারম্যান তিনি। আর ২০২০ সালে ঝং প্রতিষ্ঠান দুটি পুঁজিবাজারে যুক্ত করার পদক্ষেপ নেন, এতে তার সম্পদ মোট ৭ হাজার কোটি! ডলার বাড়ে।
ইতোপূর্বে, এশিয়ার শীর্ষ ধনী ছিলেন ভারতের বৃহত্তম শিল্প-উদ্যোক্তা মুকেশ আম্বানি। ঝং তাকে সহজেই ছাড়িয়ে যান। আম্বানির মোট সম্পদ এখন ৭৪.৭ বিলিয়ন ডলার, তিনি এবং তার পরিবার বিলাসী জীবনযাপনের জন্যেও বিখ্যাত। বসবাসের জন্যে বড় আম্বানির পরিবার ব্যবহার করেন প্রায় শত কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত একটি অভিজাত বহুতল ভবন। হিলারি ক্লিনটন থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পিছিয়ে নেই হলিউড তারকারাও, এই যেমন ২০১৮ সালে আম্বানির মেয়ের বিয়েতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন গায়িকা বিয়ন্স।
কিন্তু, মুকেশের সেরা ধনীর আসন কেড়ে নেওয়া শানশান কিন্তু নীরবে-নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করেন। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকা এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলার কারণেই তিনি ‘লোন উলফ’ নামেই পরিচিত নিজ দেশে। এমনকি গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা নিয়েও মাতামাতি নেই। ব্লুমবার্গ সূত্রমতে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তিনি গণমাধ্যমের সামনে আসতে পছন্দ করেন না। তাই তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও বেশিকিছু জানা যায়নি। তারপরও, যেটুকু জানা গেছে, সেখানে বিলাসী জীবনযাত্রার কোনো উদাহরণ মেলেনি।
এশিয়ার শীর্ষ ধনী হয়েও রহস্যময় ঝং শানশান সম্পর্কে যেসব বিষয় জানা গেছে তা এখানে তুলে ধরা হলো: ২০২০ সালে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়ে ঝাং- এর দুই কোম্পানি:
কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারের চেষ্টায় জড়িত বেইজিং ওয়ানতাই ফার্মেসি এন্টারপ্রাইজ গেল বছরের এপ্রিলে সাংহাই পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়। কোম্পানিটি দ্রুত কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরীক্ষার করার কীটও প্রস্তুত করে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে হংকং পুঁজিবাজারে নোংফু স্প্রিংসের ১১০ কোটি ডলারের আইপিও শানশানকে চীনের তৃতীয় সেরা ধনীতে পরিণত করে। ওই সময় তার সম্পদ ১৬ বিলিয়ন ডলার থেকে তার সম্পদ উন্নীত হয় ৫ হাজার কোটি ডলারে।
নোংফু স্প্রিংস’ই তার সিংহভাগ সম্পদের উৎস। ব্লুমবার্গ জানায়, তিনি কোম্পানিটির ৮৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক। আর বেইজিং ওয়ানতাই’ এ তার অংশীদারিত্ব ৭৪ শতাংশ।
মুকেশ আম্বানিকে ছাড়িয়ে ডিসেম্বর নাগাদ এশিয়া সেরা হয়ে ওঠা:
মুকেশ আম্বানি এমন এক শিল্প সংস্থার চেয়ারম্যান যার অধীনে আছে জ্বালানি থেকে টেলিকম পর্যন্ত নানা রকমের ব্যবসা। তিনি টানা দুই বছর ধরে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী ছিলেন। কিন্তু, চলতি জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ ঝং এর সম্পদ ছিল তার চাইতে ১ হাজার কোটি ডলার বেশি।
তবে ৭৪.৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে ভারতের শীর্ষ ধনীর আসন ধরে রেখেছেন মুকেশ। তিনি একাধারে বিশ্বের ১২তম শীর্ষ ধনীও বটে আর ঝং হচ্ছেন সপ্তম।
ঝং ও আম্বানির জীবনযাত্রায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য:
মুম্বাইয়ের অভিজাত এলাকায় ২৭ তলা এক আলিশান বহুতল ভবনে পরিবারসহ বসবাস মুকেশ আম্বানির। তার এই বাড়ির বিলাসী আয়োজন নিয়ে অনেক সংবাদই শোনা যায়। যেমন; ওই বাড়িতে আছে তিনটি হেলিকপ্টার প্যাড। গ্যারেজে আছে ১৬০টি গাড়ি। ২০১০ সালে বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং ওই সময় তা ভারতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
চীনের এর আগের সেরা ধনী জ্যাক মা’ কিন্তু বিলাসবহুল আবাসন সম্পত্তিতে অনেক বিনিয়োগ করেছেন। নিউইয়র্কে তিনি ২৩ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কিনেছেন। শোনা যায়, হংকংয়ে তিনি ১৯১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি ম্যানশনেরও মালিক।
আলোচিত দুই ধনীর চাইতে সম্পদশালী হয়েও ঝং কখনো অতিদামি আবাসন সম্পদে বিনিয়োগ করেননি:
পূর্ব চীনের ১ কোটি বাসিন্দার শহরে হুয়াংঝৌ’তে থাকেন তিনি। শহরটি বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং নয়নাভিরাম ভূপ্রকৃতির জন্য সুপরিচিত। কিন্তু, এটি ধনীদেরও শহর। সিএনএন বিজনেস সূত্রমতে, ২০১৬ সাল নাগাদ এই শহরের ৩২ জন ব্যবসায়ী বিলিয়নিয়ার ছিলেন। জ্যাক মা’ও এ শহরেই জন্মেছিলেন।
ঝং থাকেন হুয়াংঝৌ’র শিহু অঞ্চলে। এই এলাকার সীমান্তেই আছে শহরটির অপরূপ সৌন্দর্যের উৎস পশ্চিম হ্রদ।
হুয়াংঝৌর ঘনবসতি পুর্ণ কেন্দ্রীয় আবাসিক এলাকা থেকে এই অঞ্চলের দূরত্ব মাত্র চার মাইল। এখানেই অবস্থিত শানশানের বোতলজাত পানীয়ের কোম্পানি নোংফু স্প্রিংসের সদর দপ্তর। গাড়িতে চড়ে ঝং এর বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র ৭ মিনিট। আর জ্যাক মা’র অ্যান্ট গ্রুপের সদর দপ্তরও এখানেই।রাজনীতি বা ব্যবসায়িক জোটে জড়িত না থাকায় চীনে তিনি ‘লোন উলফ’ নামেই পরিচিত:
চীনা গণমাধ্যম দ্য পেপারের মতে, জনসম্মুখে খুব একটা আসতে চাননা ঝং শানশান।
গণমাধ্যমেও তার উপস্থিতি অতি-বিরল। দ্য পেপার তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়, “আমি সাদামাটা নিভৃতচারী মানুষ। তাই আমার সহকর্মী (অন্য ধনীরা) কী করছেন বা কী ভাবছেন- তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।”
অন্যদিকে, আম্বানি প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে অসংখ্যবার ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন। বলিউড তারকা থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা সুবিদিত। মেয়ের বিয়েতে তিনি ১০ কোটি ডলার খরচ করে এলাহি আয়োজন করেছিলেন।
সাধারণের স্তর থেকে উঠে আসার কারণেই হয়তো ঝং এমন নিভৃতচারী:
সম্পদের জৌলুস দেখার আগে ঝং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। জীবিকার দায়ে একজন নির্মাণ কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর, ১৯৮০’র দশকে সাংবাদিকতাও করেন।
ঝেঝিয়াং ডেইলি’ নামের ওই পত্রিকায় ১৯৮৩ সালে যোগ দেন ঝং। সেখানে তিনি কৃষি নিয়ে প্রতিবেদন লিখতেন। পাঁচ বছর সাংবাদিকতার পর তিনি নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। ফরাসী দৈনিক লা মঁদ জানায়, এরপর, মাশরুম বা ঘরের পর্দা বিক্রির মতো বহু ধরনের ব্যবসায় ভাগ্য পরীক্ষা করেন তিনি।
পরবর্তীকালে তিনি ইয়াংশেংটাং কো. লিমিটেড নামে একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কোম্পানিটিই আজকের বেইজিং ওয়ানতাই। আর ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নোংফু স্প্রিংস। এই কোম্পানির পণ্য বিপণন, বিজ্ঞাপন এবং মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা সরাসরি নিজে দেখাশোনা করেন ঝং।
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার