এশিয়া ও প্রশান্ত মহাশাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিতে অগ্রসর দেশগুলো করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই দ্রুততার সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব ও সংক্রমণ উৎস শনাক্তের মতো পদক্ষেপ নেয়। তবে চটজলদি টিকাদানে আগ্রহী নয় এসব দেশের সরকার। ফলে পশ্চিমা দেশে যখন টিকা দেওয়া হচ্ছে, তখন টিকার ঝুঁকি নির্ণয়েই যেন ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করেছে তারা।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে লাখো প্রাণ, জীবিকা বিপন্ন করেছে কোটি মানুষের। তবু অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং- এর মতো স্বশাসিত ভূখণ্ডের কর্তৃপক্ষ আগে বৈশ্বিক টিকাদানের প্রভাব পর্যবেক্ষন করছে। কোনো টিকা অনুমোদনের আগে যথেষ্ট সময়ও নিচ্ছে তারা। পশ্চিমা দেশগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নিজ জনগণকে টিকাদানের যে উদ্যোগ নিয়েছে এ যেন তার ঠিক বিপরীত চিত্র।
মহামারীর অবসান ঘটিয়ে জনজীবন স্বাভাবিক গতিতে ফেরানোর তাগিদ থেকে দেখলে ধীরে চলার এই নীতি বিস্ময়কর ঠেকে, তবে সেটা যুক্তি বিবর্জিত নয়। মূলত, সংক্রমণ হার কম থাকার কারণেই একটু অপেক্ষা করে অন্যান্য দেশের টিকাদান কার্যক্রমে নজর রাখছে এশীয় সরকারগুলো। অবশ্য, এতে ঝুঁকিও কম নয়। বিশেষ করে, এই অঞ্চলের যেসব দেশ দ্রুত টিকাদানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে পূর্ণগতিতে সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেই তুলনায় দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ারা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তেও পারে।
তাই যারা নেয়নি, নিজ দেশের মধ্যেই সেসব কর্তৃপক্ষকে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে নিউজিল্যান্ডের কথা। অগ্রসর অর্থনীতিগুলোর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশটি ব্লুমবার্গের কোভিড প্রতিরোধের তালিকায় ছিল সবার শীর্ষে। প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবও দেশটি সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে। মহামারী মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ান কিউই প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন। তবে সম্প্রতি তাকে বিরোধীদলের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়।
নিউজল্যান্ড ‘টিকাদান কর্মসূচিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাইতে কেন পিছিয়ে আছে’ আর্ডার্নের কাছে সে ব্যাখ্যা দাবি করে বিরোধী দল। দক্ষিণ কোরিয় সংবাদপত্র হাঙ্কোয়োরেহ’তে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘চিরকাল আমরা জনগণকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বন্ধ রাখতে বলে অর্থনৈতিক যন্ত্রণার মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’
অর্থাৎ, দ্রুত টিকাদান শুরুর আকাঙ্ক্ষা জনগণের মধ্যে জোরেশোরেই আছে। আর এই দেশগুলো আর্থিকভাবেও পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় কোনো অংশেই কম সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারপরও, ধীরে চলো নীতিকে নিরাপদ উল্লেখ করে তার স্বপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন এসব দেশের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তাদের একজন হচ্ছেন হংকংকে শাসন করা নির্বাহী পরিষদের সদস্য ডা. ল্যাম চিং-চই।
তিনি বলেন, “একটু অপেক্ষা করা অন্যরা কী করছে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দোষণীয় কিছু নয়। যেসব দেশের পরিস্থিতি গুরুতর এবং যারা এমন অপেক্ষা করতে পারছে না, তাদের ব্যাপারে আমি সমবেদনা অনুভব করি। তাদের হাতে সত্যিই সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই, দ্রুত মহামারী নির্মুলে সেজন্যেই তারা চেষ্টা করছে।”
দ্রুত টিকাদানে এগিয়ে থাকা ১০ দেশ
ডা. ল্যামের বক্তব্য হংকং- এর পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক হতেই পারে। সেখানে বর্তমান দৈনিক সংক্রমণ হার কয়েক ডজনের বেশি নয়, মৃতের সংখ্যাও কম, মাত্র ১৬১ জন। এজন্য আরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আরও তথ্য বিশ্লেষণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিভাগ। আর এখনও কোনো টিকা অনুমোদন না দিলেও ফেব্রুয়ারি থেকে টিকাদান শুরুর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
মহামারীর শুরুতেই অনাবাসীদের জন্যে সীমান্ত বন্ধ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। আর সংক্রমণ দেখা দেওয়া মাত্রই চালু করে কঠোর লকডাউন। দেশটির বিশেষজ্ঞরা চলতি জানুয়ারির শেষ নাগাদ ফাইজার/ বায়োএনটেকের তৈরি প্রতিষেধক অনুমোদন দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা স্বীকৃতি পেতে পারে ফ্রেব্রুয়ারিতে। আর ওই মাসেই টিকাদানও শুরু হবে।
সেই তুলনায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই জোরগতিতে চলছে টিকাদানের কার্যক্রম। গত মাসে জরুরি অনুমোদনের পর থেকে এপর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ডোজ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল দিয়েছে ২০ লাখ ডোজ। অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০০ জনের ২২ জন টিকা পেয়েছে।
টিকা নিয়ে উদ্বেগ:
সার্স কোভ-২ জীবাণু মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য গতিতে টিকা উদ্ভাবন করা হয়। অনুমোদিত এবং উচ্চ-সফলতা আসা কিছু টিকা যেমন; ফাইজার ও মডের্নার তৈরি ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত হয় এমআরএনএ প্রযুক্তি। টিকা তৈরিতে এটাই প্রযুক্তিটির প্রথম ব্যবহার। এটি দেহকোষে বিশেষ সংকেত পাঠিয়ে নির্দিষ্ট জীবাণু প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি সুরক্ষা কবচ তৈরির নির্দেশ দেয়। তাছাড়া, ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে কোনো রোগ প্রতিরোধে টিকাদান শুরু হয়েছে। এসব নিয়েই উদ্বিগ্ন এশিয়া-প্যাসিফিকের উন্নত অর্থনীতির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যেই, লাখ লাখ মানুষ বড় কোনো অসুবিধা ছাড়া টিকা নিয়ে সুস্থ থাকলেও, অ্যালার্জির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে কারো কারো দেহে। আবার ফাইজার টিকা নেওয়ার পর ১৬ দিন পর এক স্বাস্থ্য কর্মী মারা যান। অবশ্য, এর পেছনে টিকার ভূমিকা সম্পর্কিত যোগসূত্র এখনও মেলেনি।
এব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভায়রোলজিস্ট অ্যাডাম টেইলর বলেন, “যারা টিকা বিতরণ শুরু করেছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে যারা শুরু করেনি, তারা শিক্ষা নিতে চায়। বিতরণের সফল প্রক্রিয়া এবং ভ্যাকসিন নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি তথ্য পাওয়া গেলে তারা দৃঢ় আস্থার সঙ্গে নিজ দেশে টিকাদান শুরু করতে পারবেন। ফাইজার ও মডের্নার টিকায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি এর আগে কখনো মানবদেহে এত ব্যাপকমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়নি। এগুলোর নিরাপত্তা তথ্য আশাব্যঞ্জক। তারপরও যত বেশি উপাত্ত মিলবে, ততোই ভালো।”
চটজলদি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো আইনি বাধ্যবাধকটার ছাড় পেয়ে যাচ্ছে, এমন প্রসঙ্গেও উদ্বিগ্ন কিছু দেশ, দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পার্ক নিয়ংঘু বলেন, মহামারীর অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে কয়েকটি দেশকে জোর করে ‘অসম চুক্তি’ স্বাক্ষরে বাধ্য করেছে কিছু কোম্পানি। আমরা সেটা নিজ জনগণের ক্ষেত্রে হতে দেব না। উৎপাদক সংস্থার জবাবদিহি নিশ্চিত করেই আমাদের সরকার টিকা ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে।
সূত্র: ব্লুমবার্গ