আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, আমার প্রিয়তম আমাকে (উপদেশ দিয়ে) বলেছেন, ‘তোমরা যেখানে থাকো আল্লাহকে ভয় কোরো, পাপ কাজ হওয়ার পর পুণ্য কোরো। কেননা পুণ্য পাপ মিটিয়ে দেয় এবং মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ কোরো।’ (সুনানে তিরমিজি)
আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত এই হাদিস নবীজি (সা.)—এর জামিউল কালিমের (কথা সংক্ষিপ্ত মর্ম বিস্তৃত) অন্তর্ভুক্ত। হাদিসটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর প্রতিফলন মুমিনের জীবনে গভীর প্রভাবক। নিম্নে হাদিসের মর্ম বিশ্লেষণ করা হলো।
সর্বত্র আল্লাহকে ভয় করা
হাদিসে বলা হয়েছে, তুমি যেখানে থাকো আল্লাহকে ভয় কোরো। যেখানেই থাকো কথাটি অত্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ তুমি একাকী থাকো বা মানুষের ভিড়ে, পরিচিত মানুষের ভেতর থাকো বা অপরিচিত জনদের ভেতর, মসজিদে থাকো বা ঘরে-বাজারে থাকো, ইবাদতে মগ্ন থাকো বা পার্থিব কাজে লিপ্ত থাকো—যেখানে, যেভাবে ও যে কাজেই থাকো সর্বদা স্মরণ রাখবে আল্লাহ আমাকে দেখছেন এবং আমার ভেতর-বাহির সম্পর্কে অবগত আছেন। আমরা আমাদের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা হাত-পা, চোখ, কান ও জিহ্বা দ্বারা যা কিছু করি আল্লাহ তা দেখছেন, শুনছেন এবং জানছেন। আর আমাদের যেসব বড় বড় গোপন পাপ আছে যেমন—অহংকার, হিংসা, মন্দ ধারণা ইত্যাদি সেগুলো সম্পর্কেও আল্লাহ অবগত আছেন। যেমনটি তিনি বলেছেন, চোখের অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত।’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ১৯)
গুনাহের প্রতিবিধানে নেকি
দ্বিতীয় উপদেশ হলো যদি কখনো কোনো গুনাহ হয়ে যায় সাথে সাথে নেক কাজ করে নেওয়া। মানুষের আমলনামায় প্রতিটি ভালো কাজ ও প্রতিটি মন্দ কাজ লিপিবদ্ধ হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘কেউ অণু পরিমাণ সত্কাজ করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসত্কর্ম করলে সে তাও দেখবে।’ (সুরা জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)
এ জন্য কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নেক আমল করার মাধ্যমে তা বিলোপ করতে হবে। আলেমরা বলেন, এটাও বিবেচ্য বিষয় যে, কোন ধরনের নেক আমলে কোন প্রকারের পাপ মিটে যায়। বিষয়টি এমন নয় যে, যে কোনো নেক আমলে যে কোনো পাপ কাজ মিটে যায়। যেমন কেউ নামাজ ত্যাগ করল এবং প্রত্যেক নামাজের জন্য সদকা করল, এতে তার নামাজ ত্যাগের পাপ মোচন হবে না। কারো অধিকার বিনষ্ট করেছেন এবং বিপরীতে রোজা রেখে তা মিটিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন, এতে গুনাহ মাফ হবে না।
শরিয়ত কিছু গুনাহের প্রতিবিধান হিসেবে কিছু নেক আমল ঘোষণা করেছে। এসব গুনাহের প্রতিবিধান এভাবেই করতে হবে। যেমন কেউ কসম ভঙ্গ করলে সে কাফফারা দেবে, ফজরের সময় চোখ খোলেনি—হাদিসের ভাষ্যানুসারে ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে নামাজ আদায় করে নেবে। কিছু গুনাহ এমন যার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিবিধান নেই। যেমন মুখ থেকে মিথ্যা বের হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে না, কিছু সদকা কোরো এবং কোনো নেক আমল করে নাও ক্ষমাকারী আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু।
মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা
আমরা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবো। কেননা কিয়ামতের উত্তম আখলাক মিজানে সবচেয়ে ভারী হবে। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তারাই আমার নিকটবর্তী হবে যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। (মিশকাত)
উত্তম আখলাকের একটি দিক হলো মানুষ যে পরিস্থিতি প্রতিক্রিয়া দেখায় তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। সাধারণ সময় সবাই হাসি মুখে কথা বলে, ভালো মেজাজ দেখায়, কিন্তু যখন কারো সঙ্গে বাড়াবাড়ি হয়, কোনো বেয়াদবি হয়, অন্যায় আচরণ করা হয়, তখন দেখা যাবে তার চরিত্র আসলে কেমন?
উত্তম আখলাকের অধিকারী হতে হলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তার ইতিহাস ও সিরাত পড়তে হবে। মহানবী (সা.) সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি কখনো ব্যক্তিগত কারণে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। অথচ শরিয়ত জুলুমের সমপরিমাণে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। প্রথম জীবন থেকে নবুয়াতের পর পর্যন্ত। তায়েফের ঘটনা সবার জানা। ফেরেশতা এসে বলল, আপনি অনুমতি দিলে এই জনপদের বাসিন্দাদেরকে দুই পাহাড়ের ভেতরে পিষে ফেলা হবে। তিনি বললেন, আমি আশা করি, তাদের সন্তানরা ঈমান গ্রহণ করবে এবং ইসলামের জন্য কাজ করবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নবীজি (সা.)-এর উপদেশের ওপর আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: মহাপরিচালক, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।
ভাষান্তর: মো. আবদুল মজিদ মোল্লা।

