বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা যেকোনো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের মুখে আবারও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে এত প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এই সময়ে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে এবং ৯০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফলে তাদের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে এবং বিদ্যুৎ, শিক্ষা, পয়ঃনিষ্কাশনের মতো সেবায় প্রবেশাধিকার বেড়েছে।
তবে ২০১৬ সালের পর থেকে এই গতি কমেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ায় ধনী জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি সুফল পাচ্ছে, ফলে আয়বৈষম্য বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষির ওপর ভর করে দারিদ্র্য হ্রাসে এগিয়ে থাকলেও শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। ২০২২ সালে প্রতি চারজনের একজন শহরে বসবাস শুরু করায় নগরায়ণও বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরম দারিদ্র্য ২০১০ সালের ১২.২ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৬ শতাংশে। একই সময়ে মাঝারি দারিদ্র্য ৩৭.১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৮.৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জাঁ পেম বলেন, বহু বছর ধরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্যের জন্য পরিচিত। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধীরগতির কারণে শ্রম আয়ে চাপ বেড়েছে। প্রথাগতভাবে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি ধরে রাখা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য কমাতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিশেষ করে যুব, নারী ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য।
প্রতিবেদনে কর্মসংস্থানে স্থবিরতার বিষয়টিও উঠে এসেছে। উৎপাদনশীল খাতে চাকরি না বাড়ায় নারী ও তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশে প্রতি পাঁচজন নারীর একজন বেকার, আর শিক্ষিত নারীদের প্রতি চারজনের একজনের কর্মসংস্থান নেই। ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি প্রায় স্থবির।
১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের প্রায় অর্ধেকই কম মজুরিতে কাজ করছেন যা দক্ষতা ও বাজার চাহিদার অসঙ্গতি নির্দেশ করে।
এছাড়া অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন বাংলাদেশের অনেক পরিবারের দারিদ্র্যমুক্তির অন্যতম পথ হিসেবে চিহ্নিত হলেও, বিদেশে যেতে উচ্চ ব্যয় এবং দেশে শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় অভিবাসীদের নিম্নমানের জীবনযাপন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির দুর্বল ব্যবস্থাপনাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২২ সালে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাভোগীদের ৩৫ শতাংশই ধনী পরিবারের সদস্য, যেখানে অতি দরিদ্র পরিবারের অর্ধেকও এসব সুবিধা পায়নি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারের ভর্তুকির বড় অংশও ধনী পরিবারে পৌঁছায়।
দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে প্রতিবেদনে চারটি প্রধান করণীয় তুলে ধরা হয়েছে
১) উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি মজবুত করা
২) দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি
৩) প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো ও দরিদ্রবান্ধব বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা
৪) কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও শক্তিশালী রাজস্বনীতি নিশ্চিত করা
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরি বলেন, বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্য কিছুটা কমাতে সক্ষম হয়েছে, যদিও জলবায়ু ঝুঁকি শহর-গ্রামের বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উদ্ভাবনী নীতি, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, শহরে গুণগত কর্মসংস্থান এবং কৃষিতে দরিদ্রবান্ধব মূল্যশৃঙ্খল নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসের গতি পুনরুদ্ধার ও ত্বরান্বিত করতে পারবে।

