ভাবুন আপনি বসে আছেন, কাজ করছেন বা রাস্তায় কোথাও যাচ্ছেন। হঠাৎ কেঁপে উঠলো আপনার আশপাশের সবকিছু। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো আপনার চারপাশে। ভূমিকম্পের সময় একটা ঝাঁকুনির পর আরও আফটারশকের শঙ্কা থাকে। তাই একবার হওয়ার পর আপনি যে নিরাপদ অবস্থানে আছেন, বিষয়টা এমনও নয়। তাই এ বিষয়ে সবসময় সতর্ক এবং সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
ভূমিকম্প কখন হবে, তার আগে নিশ্চিতভাবে জানার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি এখনো পৃথিবীতে নেই। ব্যক্তিগত প্রস্তুতি, ভবনের নিরাপত্তা, জরুরি উদ্ধার পরিকল্পনা—এসব বিষয় আগে থেকেই নিশ্চিত রাখা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমিকম্পে প্রাণহানি কমাতে দরকার সতর্কতা। এর জন্য দরকার মহড়া বাড়ানো। এর পাশাপাশি সচেতনতা তৈরিতে জোর দিতে হবে।
তাই এই অবস্থায় আপনাকে সচেতন হওয়া ছাড়া বাস্তবসম্মত তেমন কোনও উপায় নেই। এবার আলোচনা করা যাক এই অবস্থায় আপনি কী পদক্ষেপ নিতে পারেন-
ঘরের ভেতরে থাকলে কোথায় আশ্রয় নেবেন?
ভূমিকম্প শুরুর মুহূর্তে যদি আপনি বিছানায় থাকেন, সঙ্গে সঙ্গে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিন। অন্য কোথাও থাকলে টেবিল, ডেস্ক বা মজবুত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। এতে দেয়াল বা ছাদের টুকরা মাথায় পড়ার ঝুঁকি কমে যায়। আমেরিকান রেডক্রসের পরামর্শ অনুযায়ী- ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন, তারপর কোন শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন।
তবে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকলে দ্রুত খোলা জায়গায় চলে যান। বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে ভবনের কোনো পিলারের পাশে দাঁড়ানো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বলে মত বিশেষজ্ঞদের। জরুরি বিষয় হলো আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। অনেক সময় বহুতল ভবনে থাকলে আতঙ্কে অনেকে লাফ দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয়। এমনটা করা যাবে না। সতর্কতার সাথে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। অনেকেই ভয় পেয়ে শারীরিকভাবে অস্বস্তিতে পড়ে যান, যা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
গ্যাস ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন
ভূমিকম্পের সময় গ্যাস চুলা জ্বালিয়ে রাখা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কম্পনের শুরুতেই গ্যাস চুলা বন্ধ করুন। কম্পিউটার, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ করে রাখা উচিত, যাতে আগুন লাগা বা শর্টসার্কিটের ঝুঁকি না বাড়ে।
ধুলাবালির মধ্যে শ্বাসরোধ ঠেকাতে যা করবেন
দেয়াল বা সিলিং ভেঙে পড়লে অস্থির না হয়ে সঙ্গে থাকা কাপড় বা ওড়না দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। এতে ধুলাবালি শ্বাসনালীতে ঢুকে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কমে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বাজার, হাসপাতাল বা সিনেমা হলে থাকলে হুড়োহুড়ি করবেন না। ধাক্কাধাক্কিতে বড় দুর্ঘটনা ঘটে।
লিফট নয়, সিঁড়িই হবে নিরাপদ পথ
ভূমিকম্পের সময় বা কম্পন থেমে যাওয়ার পর কখনই লিফট ব্যবহার করবেন না। লিফট আটকে যাওয়া বা নেমে আসার ঝুঁকি থাকে। নিরাপদে নিচে নামতে সবসময় সিঁড়ি ব্যবহার করুন এবং সতর্কভাবে নেমে আসুন। সিঁড়িতে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অনেক সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে।
গাড়িতে থাকলে কী করবেন?
যদি ভূমিকম্পের সময় আপনি গাড়িতে থাকেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামান—তবে অবশ্যই ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, বড় গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে। গাড়ির ভেতরেই থাকুন; কম্পন থেমে গেলে আবার যাত্রা শুরু করুন।
জরুরি উপকরণ প্রস্তুত রাখুন
দুর্যোগের মুহূর্তে কিছু জিনিস জীবন বাঁচাতে পারে। তাই আগে থেকেই একটি জরুরি কিট তৈরি রাখুন—ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, মোমবাতি, পানি, শুকনো খাবার এবং ফার্স্ট এইড বক্স। চাইলে গাড়িতেও একটি ছোট ফার্স্ট এইড বক্স রাখতে পারেন।
ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়লে করণীয়
বিম, দেয়াল, কংক্রিটের ছাদ ইত্যাদির মধ্যে শরীরের কোনো অংশ চাপা পড়লে, বের হওয়ার সুযোগ যদি না-ই থাকে, তবে বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। তাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। যদি আটকে পড়েন তাহলে ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে। চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা দেয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতায় ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শ
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করার পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
যার মধ্যে রয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা। এছাড়া ইউটিলিটি সার্ভিসের মধ্যে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন- ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসাপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নাম্বারসমূহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সকল ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখার ওপরও জোর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

