গত সোমবার ভারতের রাজধানী দিল্লির লালকেল্লার কাছে এক গাড়ি বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এর পরদিন মঙ্গলবার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে একটি ‘আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে চলতি মাসের শুরুতে দিল্লি ও ইসলামাবাদে এমন বিস্ফোরণ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। ভারত–পাকিস্তান—উভয় দেশ হামলার ঘটনাগুলোতে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা চালায়, নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ও তদন্ত শুরু করে। বিস্ফোরণের ধরন ও সময়কাল দেখে এগুলোকে পরিকল্পিত হামলা বলছেন দুদেশের সরকার মহল।
বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আফগানিস্তান। আফগান–পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষের মধ্যেই গত সপ্তাহে দিল্লি ও ইসলামাবাদে বিস্ফোরণের ওই ঘটনা ঘটলো। এতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার মতে, তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগান ভূখণ্ডে পুনরায় সক্রিয় হয়েছে। তারা অভিযোগ করছে, সেখান থেকে এ গোষ্ঠী পাকিস্তানে হামলার পরিকল্পনা ও তৎপরতা চালাচ্ছে। আর পাকিস্তানের মাটিতে টিটিপিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় আরেক প্রতিবেশী ভারত মদদ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।
ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সীমান্তবর্তী সংঘর্ষ, সন্ত্রাসী হামলা ও সাম্প্রতিক বিস্ফোরণগুলো উভয় দেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। এদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সোমবারের বিস্ফোরণের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও সংবেদনশীল গণমাধ্যম প্রতিবেদন উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। তাই কূটনৈতিক সংলাপ ও জনমত উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এ ঘটনার তদন্ত করছে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে। তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ); যা ‘সন্ত্রাসবাদ’ সম্পর্কিত মামলার তদন্ত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। বিস্ফোরণের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কর্তৃপক্ষ কঠোর ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ ধারাগুলো কাজে লাগাচ্ছে।
এদিকে বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক প্রস্তাবে দিল্লির ঘটনাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির হাতে সংঘটিত একটি নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম থেকেই এ ঘটনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, চক্রান্তকারীদের কেউ রেহাই পাবেন না, সবাইকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সেই একই সুর শোনা গেছে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কণ্ঠে। অমিত শাহ বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে’ তিনি সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। তারা সতর্ক করেছেন যে সামরিক উত্তেজনা বা সীমান্তে ছোট সংঘর্ষও বৃহত্তর সংঘাতে পরিণত হতে পারে। ভারত–পাকিস্তানকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
পুলিশ বলেছে, এ সেল নিষিদ্ধ সংগঠন জেইএম ও আনসার গাজওয়াত-উল-হিন্দের (এজিইউএইচ) সঙ্গে যুক্ত। জেইএম পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন এবং ভারতে তাদের হামলা চালানোর নজির রয়েছে। মে মাসে পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনী ‘জেইএমের ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এ ছাড়া, এজিইউএইচ হলো, আল–কায়েদায় অনুপ্রাণিত এক কাশ্মীরি সশস্ত্র সংগঠন। হিজবুল মুজাহিদীন থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয়েছে এটি। হিজবুল মুজাহিদীনও পাকিস্তানভিত্তিক একটি সশস্ত্র সংগঠন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতীয় একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আল–জাজিরাকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, দিল্লির বিস্ফোরণের পেছনে যারা রয়েছেন, তাদের জন্য পাকিস্তানভিত্তিক কিছু গোষ্ঠী লজিস্টিক সমর্থন দিয়েছে। তবে প্রকৃত হামলাকারীরা ‘স্থানীয় এবং নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিকল্পনা করেছে’ বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের এ কাজের জন্য কীভাবে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটাও খতিয়ে দেখছি আমরা।
ভারত সরকার যখন জানিয়েছিলো, দিল্লির বিস্ফোরণের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করা হবে, এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের রাজধানীতে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণটি ঘটে যায় যাতে ১২ জন নিহত হন। এদিকে ইসলামাবাদের একটি আদালত কমপ্লেক্সের বাইরে এ বিস্ফোরণ ঘটে এমন সময়, যখন পাকিস্তানের সেনারা খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের আফগান সীমান্তের কাছের ওয়ানা শহরে এক ক্যাডেট কলেজে একটি হামলার ঘটনায় উদ্ধারকাজে ব্যস্ত ছিলেন।
এদিকে ইসলামাবাদে বিস্ফোরণের ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া বেশ স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ওই ঘটনা ছাড়াও ক্যাডেট কলেজে হামলার ঘটনায়ও তিনি ভারতকে দায়ী করেছেন। শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘দুটি হামলাই এই অঞ্চলে ভারতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নিকৃষ্টতম উদাহরণ।’ যদিও নিজের বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেননি তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে শাহবাজ শরিফ আরও বলেন, ‘বিশ্বের এখন সময় এসেছে, ভারতের এ ধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্রের নিন্দা জানানোর। সন্ত্রাসবাদের অভিশাপকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না করা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।’ এদিকে ভারত-পাকিস্তান এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই তালেবান–শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তেজনা বেড়ে চলছে। পাকিস্তান–আফগানিস্তান দুই প্রতিবেশি গত মাসে সীমান্তে একাধিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এসব সংঘর্ষ হয় আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ভারত সফরে থাকাকালে; যা নয়াদিল্লি ও কাবুলের মধ্যে একটি নতুন এবং শক্তিশালী জোট গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।
বলা বাহুল্য যে দশক ধরে পাকিস্তান ছিলো তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ভারতও আফগান গোষ্ঠীটিকে ইসলামাবাদের একটি প্রতিনিধি হিসেবে দেখতো। যদিও সেই ভূমিকা এখন বদলেছে, পাকিস্তান তালেবানকে অভিযুক্ত করছে যে তারা ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে। তাদের আরও অভিযোগ, ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি)–কে আশ্রয় দিচ্ছে আফগান তালেবান। টিটিপি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাকিস্তানে কয়েকটি বড় হামলাসহ ইসলামাবাদে মঙ্গলবারের বিস্ফোরণেরও দায় স্বীকার করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ভারত সমর্থন দিচ্ছে—ইসলামাবাদ এ অভিযোগ তুললেও তারা নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিশোধ নেবে, তা এখনো প্রকাশ করেনি।
এদিকে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও সংবেদনশীল গণমাধ্যম প্রতিবেদন উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে। তাই কূটনৈতিক সংলাপ ও জনমত উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি দুই দেশের সীমান্ত নীতি ও সামরিক প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের গণমাধ্যমও বিস্ফোরণ এবং পারস্পরিক অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যম সন্ত্রাসী হামলার প্রভাব, নিরাপত্তাব্যবস্থার কার্যকারিতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করছে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম সরকারি বিবৃতি, বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া ও সন্ত্রাসীদের দায় তুলে ধরছে। বিশেষজ্ঞদের মত, এখন গণমাধ্যমগুলো জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক চাপ
দিল্লি ও ইসলামাবাদে বিস্ফোরণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা বাড়লে ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। উভয় দেশকে সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। ভারত-পাকিস্তানকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
চীন জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা এড়াতে কূটনৈতিক চ্যানেল সক্রিয় করেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষা করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ভারত–পাকিস্তান ছাপিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জটিল নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। অবশ্য, দুই দেশ সতর্কতা, সংযম ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সংঘাতের আশঙ্কা এড়াতে পারে। সঠিক কৌশল ও সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথে হাঁটলে এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, রয়টার্স, ডন, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস

