মানুষের জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান এক সম্পদ হচ্ছে সময়। সময়কে যে যত বেশি কাজে লাগাতে পারে, সে দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় জাহানের তত সাফল্য অর্জন করতে পারে। অথচ এই মূল্যবান সময়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কিয়ামতের আগে তা সংকুচিত হয়ে আসবে। তখন এর কাজে লাগানোর সতর্কতা আরও অনেক বাড়াতে হবে। কালের পরিক্রমায় আজকের দ্রুতগামী যুগে আমরা যেন সময়ের সে যুগেই প্রবেশ করেছি। চোখের পলকে মুহূর্তগুলো অতীতের ছায়া হয়ে রয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি, আধুনিক জীবনযাত্রা, সামাজিক চাপ—সব মিলিয়ে আমরা সময়কে ধরে রাখতে পারছি না।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না জ্ঞান উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে, হত্যাযজ্ঞ বৃদ্ধি পাবে এবং সম্পদ উপচে পড়বে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬৭২)
হাদিসের ভাষ্যমতে কিয়ামতের পূর্বে এমন সময় আসবে যখন মানুষকে মনে হবে সময় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এ সময় শুধু দৈহিক নয়, বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকেও সময় অল্প মনে হবে। তাই তো এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সময় সীমিত, কাজের সুযোগ ক্ষণস্থায়ী—তাই প্রতিটি মুহূর্তকে সৎকর্মে ব্যয় করা প্রয়োজন।
চলুন দেখি— ‘সময় সংকুচিত হয়ে যাবে’ কিয়ামতের এই আলামতের অর্থ কী, তার নৈতিক ও সামাজিক প্রভাব কীভাবে পড়ে, এবং আজকের জীবনে আমরা কীভাবে সময়কে কল্যাণময় কাজে ব্যবহার করতে পারি।
হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে সময় সংকোচনের অর্থ
ইসলামি স্কলারগণ সময় সংকোচনের অর্থকে দুই দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন—
(এক) বাস্তব অর্থে: দিন-রাতের সময় যেন দ্রুত অতিক্রম হয়। মানুষ বলে, ‘আজকাল দিনগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে।’ মানুষের আয়ু ও কাজের ফল দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ী মনে হয় না; জীবনের সময় কমে আসার অনুভূতি তৈরি হয়।
(দুই) রূপক অর্থে: দূরত্ব, স্থান ও যোগাযোগের মাধ্যমে পৃথিবী যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি, বিমানের যাত্রা, ইন্টারনেট—সবই দূরত্বকে দ্রুত অতিক্রম করার সুযোগ দিয়েছে। এটি নবীজির পূর্বাভাসের বাস্তবায়ন: মানুষ সময়ের সংক্ষিপ্ততা অনুভব করবে।
সময় সংকোচনের সামাজিক প্রভাব
সময় দ্রুত চলে যাওয়ার অনুভূতি কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলে।
ইবাদত বা আমলে প্রতিরোধ তৈরি করে: মানুষের মনে হয় সময় নেই, তাই ইবাদত ও সৎকর্মে উদাসীনতা বৃদ্ধি পায়।
অলসতা ও উদাসীনতা তৈরি করে: দ্রুত অতিক্রান্ত সময় মানুষকে উদ্বেগে ফেলে দেয়। জীবনের মূল্য বোঝার আগেই দিনগুলো চলে যায়।
অবহেলা ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে: মানুষ প্রতিদিনকার কাজে ব্যস্ত, কিন্তু নৈতিকতা, জ্ঞান ও সম্পর্কের দিকে মনোযোগ কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আজকের শহুরে জীবন দেখা যেতে পারে—যেখানে মানুষ দিনের অর্ধেক সময় নানা ডিভাইস ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত। প্রকৃত অর্থে সময়ের ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এটি নবীজির পূর্বাভাসেরই বাস্তব প্রতিফলন।
আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিকতা
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, দ্রুত যাত্রা, তথ্যপ্রবাহ ও ডিজিটাল উৎকর্ষতার যুগে মানুষ প্রকৃত অর্থে সময়ের সংকোচন অনুভব করছে। অফিস, যানজট, ইন্টারনেট, কাজের চাপ—সবই দিনকে ছোট করছে।
এক্ষেত্রে সময়ের সংকোচন নিয়ে মহানবী (সা.)-এর সতর্কবাণী আমাদের নির্দেশনা প্রদান করে যে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী কাজের মাঝে হারিয়ে যেও না। বরং মুমিনদের করণীয় হলো—
(এক) ইবাদত ও আমলকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এজন্য নামাজ, দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদতে বেশি বেশি লেগে থাকা।
(দুই) সময় ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা অবলম্বন করা। প্রতিদিনের কাজকে পরিকল্পিতভাবে করা; অলসতা এড়িয়ে চলা।
(তিন) নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে ত্বরান্বিত হওয়া। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবহেলা না করা।
আজকের জীবনে আমরা যখন সময়কে দ্রুত অতিক্রম করি, তখন নবীজির এই সতর্কবাণী আমাদের প্রতিদিনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুমিনের দায়িত্ব হলো—সময়কে নষ্ট না করে কল্যাণে ব্যয় করা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া ইমদাদিয়া, মুসলিম বাজার, মিরপুর।