চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে ফের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দখলদার ইসরায়েল। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি।
সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়, ইসরায়েল হয়তো আগেই— আগস্টের শেষ দিকেই— বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে। যার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটতে পারে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানও সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় নিজেকে সক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করছে। ফরেন পলিসির ভাষায়, “আগামী যুদ্ধ আগের তুলনায় অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী হতে পারে।”
আগের যুদ্ধে অভিজ্ঞতা, এবার প্রস্তুতি ভিন্ন
মূল লক্ষ্য হবে, “ইসরায়েল অপ্রতিরোধ্য” — এই ধারণা ভেঙে দেওয়া।
ফরেন পলিসির শঙ্কা: যুক্তরাষ্ট্রও জড়াতে পারে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে
জুনের যুদ্ধ: লক্ষ্য ছিল কৌশলগত আধিপত্য
ফরেন পলিসির ভাষ্য- জুনে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না শুধু পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। বরং মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ইসরায়েলের পক্ষে টেনে আনা ছিল মূল উদ্দেশ্য।
তখন তিনটি বড় লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করে তেল আবিব:
যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনা
ইরানি শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটিকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করা
যদিও ইসরায়েল কেবল আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সীমিত বিমান হামলা চালাতে সম্মত হন, তবে পুরোপুরি যুদ্ধে যেতে রাজি হননি।
যুদ্ধের ফলাফল: আংশিক সাফল্য, বড় ব্যর্থতা
গত জুনের যুদ্ধে ইসরায়েল ইরানের অন্তত ৩০ জন জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার ও ১৯ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করলেও এর প্রভাব ছিল স্বল্পস্থায়ী। ইরান মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিকল্প কমান্ড কাঠামো গড়ে তোলে এবং জবাবে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা আনে।
এছাড়া ইসরায়েলের প্রত্যাশা ছিল এসব হামলার ফলে ইরানি শাসকগোষ্ঠীতে বিভক্তি দেখা দেবে। মোসাদের এজেন্টরা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ফোনে হুমকি দিয়েছিল বলেও জানায় ওয়াশিংটন পোস্ট। তবে এসব কৌশল ব্যর্থ হয়। বরং জাতীয়তাবাদী আবেগে ইরানি জনগণ আরও ঐক্যবদ্ধ হয়।
ইরানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নারগেস বাজোগলি বলেন, আগে আমি সরকারের বিদেশে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিরোধিতা করতাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমাদের প্রতিরক্ষাই আসল। শক্ত প্রতিরক্ষা ছাড়া যুদ্ধ সরাসরি আমাদের ঘরে চলে আসে।
ইসরায়েলের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট
যুদ্ধের সময় ইসরায়েল আংশিকভাবে ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও তা ছিল স্বল্পস্থায়ী। দীর্ঘমেয়াদে ইরানের পাল্টা আক্রমণে ইসরায়েল অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া যুদ্ধ পরিচালনা করা ইসরায়েলের পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরবরাহকৃত THAAD ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করে ফেলে তেল আবিব।
আবারও যুদ্ধের আশঙ্কা
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এবং সেনাপ্রধান ইয়াল জামির সম্প্রতি জানিয়েছেন, জুনের যুদ্ধ ছিল “প্রথম ধাপ মাত্র”। তারা বলছেন, ইরানকে আবারও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
এ প্রেক্ষিতে ইসরায়েল পুরনো কৌশল — “ঘাস কাটা কৌশল” — প্রয়োগ করতে পারে। এর মানে, প্রতিপক্ষ যাতে সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, তার আগেই একের পর এক আঘাত হেনে দুর্বল করে ফেলা।
অন্য দিকে ইরানও এবার আর পিছু হটতে চায় না। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, আবার আগ্রাসন হলে আমরা আরও কঠিন প্রতিক্রিয়া জানাবো, আর তা আড়াল করা সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুই রাস্তা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান। তিনি আগের মতো সীমিত হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের ফাঁদে পা দিতে পারেন, অথবা পুরোপুরি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন।
কিন্তু সরে দাঁড়ানো মানে কেবল একবারের জন্য ‘না’ বলা নয়, বরং ইসরায়েলের চাপের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প সে রকম কোনো দৃঢ়তা দেখাননি।
ফলে চলতি আগস্টের শেষভাগ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা জোরালোভাবে দেখা দিচ্ছে — যার প্রভাব শুধু অঞ্চলজুড়ে নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে।
সূত্র: ফরেন পলিসি