স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সময় থেকে ২০০০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়ার কিছু বৈঠক তুলনামূলক বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হতে থাকায় পুতিনের সাম্প্রতিক বেশির ভাগ সাক্ষাৎ বিশেষ করে ওবামা ও বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকগুলো নিষ্প্রভ ছিল।
এখানে অতীতের সেসব সাক্ষাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তুলে ধরা হলো, তাতে দেখা যাবে কীভাবে একসময় জ্যাজ কনসার্ট ও মাছ শিকারের আড্ডাগুলো শেষ পর্যন্ত হুমকিতে গিয়ে ঠেকেছে।
জুন ২০০০: পুতিন–ক্লিনটন সাক্ষাৎ
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মস্কোতে অভ্যর্থনা জানান। তিনি ক্লিনটনকে ক্রেমলিন ঘুরিয়ে দেখান। এরপর একটি রুশ জ্যাজ ব্যান্ডের পরিবেশনা উপভোগ করেন তারা।
পুতিন তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অংশীদার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মস্কো আর কখনো ওয়াশিংটনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চাইবে না। পুতিন বলেন, ‘কখনো নয়। আমরা সহযোগিতার জন্য কাজ করি। সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে সমঝোতার পথে এগিয়ে যেতে চাই।’
তবে ক্লিনটন চেচনিয়ার বিষয়ে দুই দেশের মতভিন্নতার কথা স্বীকার করেন। এ সাক্ষাতের আগের বছর রাশিয়ায় একাধিক অ্যাপার্টমেন্টে বিস্ফোরণে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হলে রুশ বাহিনী চেচনিয়ায় বড় ধরনের অভিযান চালায়। অ্যাপার্টমেন্টে বিস্ফোরণের জন্য চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করেছিল মস্কো।
২০০০ সালে পুতিন ও ক্লিনটনের চারটি সাক্ষাতের প্রথমটি মস্কোতে হয়। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব ছাড়ার আগে বহুপক্ষীয় অনুষ্ঠানের সময় বাকি তিনটি বৈঠক হয়েছিল।
নাইন–ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর পুতিন প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ফোন করে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দুই মাস পর বুশ টেক্সাসের বাংলোবাড়ি ক্রফোর্ডে পুতিনকে আমন্ত্রণ জানান। তার বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের আশা ফুটে উঠেছিল।
ওই সময় বুশ বলেছিলেন, ‘আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম, রাশিয়া আমাদের শত্রু ছিল। এখন হাইস্কুলের ছাত্ররাও রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে জানতে পারবে। আমরা একসঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক ভেঙে সহযোগিতা ও আস্থার নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, যেন শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।’ বুশ পুতিনকে একটি পিকআপ ট্রাকে বসিয়ে বিশাল বাংলোবাড়ির ঝরনার দিকে নিয়ে যান।
তবে ২০০২ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় দুজনের সাক্ষাতের সময় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার কারণে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দেয়।
জুলাই ২০০৭: পুতিন-বুশ সাক্ষাৎ
২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছিল। কিন্তু মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও বুশ পুতিনের সঙ্গে উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের কেনেবাঙ্কপোর্টে তার পৈতৃক বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। দুই নেতা যেসব ক্ষেত্রে তাঁদের মতপার্থক্য রয়েছে, তা স্বীকার করেন। অবশ্য স্বচ্ছতার জন্য একে অপরকে কৃতিত্ব দেন।
এপ্রিল ২০০৮: পুতিন-বুশ সাক্ষাৎ
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুশ ও পুতিনের শেষ বৈঠকটি রাশিয়ার সোচিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ। এতে রাশিয়া আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
বৈঠকে কোনো বড় অগ্রগতি হয়নি। দুই নেতা দ্বিমত পোষণের বিষয়ে একমত হন। তবু তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট ছিল। বুশ মোট ২৮ বার পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। শুধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে এর চেয়ে বেশি সাক্ষাৎ করেছিলেন বুশ।
জুলাই ২০০৯: পুতিন-ওবামা সাক্ষাৎ
এ সময় পুতিন প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর মিত্র দিমিত্রি মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা মস্কো সফরের সময় পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দুই দেশের মধ্যে তখন বিরোধ আরও বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ওই আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল।
ওবামা পুতিনকে বলেন, ‘আমরা সব বিষয়ে একমত না–ও হতে পারি, তবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সলাপরামর্শের মাধ্যমে এমন সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি, যা আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে।’
ওবামা বলেছিলেন, ‘সিরিয়ার সমস্যা নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য আছে। তবে সহিংসতা কমানো, রাসায়নিক অস্ত্র সুরক্ষিত রাখা এবং এর ব্যবহার বা বিস্তার ঠেকানোর বিষয়ে আমাদের স্বার্থ অভিন্ন।’
জুলাই ২০১৮: হেলসিঙ্কিতে পুতিন–ট্রাম্প বৈঠক
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ের পর (জুলাই ২০১৮) হেলসিঙ্কিতে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ট্রাম্প। এসময় পুতিন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের সময় বলেন, ‘শীতল যুদ্ধ অতীতের বিষয়। আমরা কেবল বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো—পরিবেশগত সঙ্কট থেকে সন্ত্রাসবাদ—মোকাবিলা করতে পারব যদি একযোগে কাজ করি। আশা করি আমেরিকান অংশীদারদের সঙ্গে এই বোঝাপড়া করতে পারব।’ তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এ দুই নেতার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে অবনতি ঘটেছে।
সূত্র: আল জাজিরা