আধুনিক যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেট ব্যবহার করে মানুষ জ্ঞান অর্জন, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করছে। তবে এর সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকম অনলাইন অপরাধ—মিথ্যা তথ্য প্রচার, চরিত্রহনন, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, হ্যাকিং, প্রতারণা, ফেক আইডির মাধ্যমে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া প্রভৃতি। এসব অপকর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহ, এবং এর পরিণতি ভয়াবহ।
অনলাইনে মিথ্যা ছড়ানো ভয়াবহ গুনাহ
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব, মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচার খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অথচ কোরআন মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছে যাচাই ছাড়া কোনো তথ্য বিশ্বাস না করতে—‘হে মুমিনরা! যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা যাচাই করে নেবে…।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ৬)
হাদিসে এসেছে—‘একজন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হিসেবে যথেষ্ট, যদি সে যা শুনে তা-ই বলে (যাচাই ছাড়া)।’ (সহিহ মুসলিম)
অনলাইনে যাচাই না করে সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া, ফেক নিউজ তৈরি ও গুজব রটানো নিঃসন্দেহে হারাম কাজ।
গিবত, অপবাদ ও চরিত্রহনন
সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে নিয়ে কটুক্তি, ব্যঙ্গচিত্র বা তার ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করে অপমান করা—এগুলো গিবত ও অপবাদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—‘তুমি যদি ভাইয়ের সে দোষ বর্ণনা কর যা তার মধ্যে আছে, সেটিই গিবত। আর যদি না থাকে, তবে তুমি তার প্রতি অপবাদ দিয়েছ।’ (সহিহ মুসলিম)
কোরআনে গিবতের তুলনা করা হয়েছে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে— ‘তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করুক?’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)
অনলাইনে কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, ব্যঙ্গ করা, চরিত্র হনন করা এক ধরনের গিবত এবং চরম গুনাহ।
পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীলতা ছড়ানো
বর্তমানে অনলাইন পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল কনটেন্ট একটি মহামারিতে পরিণত হয়েছে। ইসলাম এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কোরআনে আল্লাহ বলেন—‘বলুন, মুমিনদের নির্দেশ দিন যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য পবিত্রতর।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন— ‘চোখের জিনা হচ্ছে দৃষ্টি দেওয়া, জিহ্বার জিনা হচ্ছে কথা বলা, আর হূদয় কামনা করে ও আকাঙ্ক্ষা করে; লজ্জাস্থান তা বাস্তবায়ন করে বা করে না।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)
যেসকল ব্যক্তি পর্ন কনটেন্ট তৈরি বা শেয়ার করেন, তারা শুধু নিজের জন্য নয়; বরং হাজারো মানুষের গুনাহের ভাগীদার হয়ে যান।
অনলাইনে অন্যের আইডি হ্যাক করা, অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বা ফেক আইডির মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস ভেঙে দেওয়া কঠিন অপরাধ। হাদিসে এসেছে— ‘যে প্রতারণা করে, সে আমাদের [উম্মতের] অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সহিহ মুসলিম)
এ ধরনের প্রতারণা কিয়ামতের দিন হিসাবের কাঠগড়ায় অপরাধী বানিয়ে দেবে।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন
আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে মানুষ গোপনে অন্যের ছবি, কথোপকথন, লোকেশন বা মেসেজ চুরি করে। অথচ কোরআনে এসেছে— ‘তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না…।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)
অন্যের অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা মারাত্মক অন্যায়।
অনলাইন অপরাধের পরিণতি
এক. আখিরাতে জবাবদিহিতা : প্রত্যেকটি টাইপ করা শব্দ, পোস্ট করা ছবি, করা মন্তব্য—সব লিখিত হচ্ছে— ‘তোমরা যাহা করো, নিশ্চয় আমি সে বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞান রাখি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৩৩)
দুই. মানবিক ক্ষতি : অনলাইন অপরাধ অনেক সময় আত্মহত্যা, মানসিক অবসাদ ও পারিবারিক ভাঙনের কারণ হয়।
তিন. আইনি শাস্তি : ইসলামী রাষ্ট্রে এসব অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। বর্তমানে অনেক দেশেও সাইবার অপরাধের শাস্তি কঠোর।
করণীয় ও বাঁচার উপায়
এক. আল্লাহভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ : প্রত্যেক কাজে আল্লাহ দেখছেন—এই চিন্তা জাগ্রত রাখা।
দুই. সঠিক ব্যবহার শিখুন : ইন্টারনেট ব্যবহার একটি আমানত। এর সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে।
কিন. সময়ের হিসাব রাখা : অকারণে সময় অপচয় না করে ভালো কাজে নিয়োজিত হওয়া।
চার. সংশয় হলে বর্জন করুন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—‘সন্দেহজনক বিষয়গুলো বর্জন করো।’
পাঁচ. নিজে ভালো থাকুন, অন্যকে সচেতন করুন।
আসুন, আমরা ইন্টারনেটকে জ্ঞান ও কল্যাণের পথে ব্যবহার করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া, গাজীপুর।