spot_img

আরবের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা

অবশ্যই পরুন

মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষার একটি সার্বজনীন ব্যবস্থা প্রদান করত। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহ আবু জাফরের নামে নামকরণ করা এবং তাঁরই তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি বাগদাদের আব্বাসীয় স্থাপত্যের অন্যতম টিকে থাকা নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে এটি আল-মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ। দজলা নদীর বাম তীরে অবস্থিত। এটাকে আরবের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষাগত পরিধি : এই মাদরাসা ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খলিফা আল-মুসতানসির নিজেই ১২২৬ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল এটি অধ্যয়নের জন্য খোলা হয়। এর নির্মাণে ৭ লাখ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় হয়েছিল। আব্বাসীয় আমলে মাদরাসাগুলো ইসলামিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার প্রসারের প্রধান মাধ্যম ছিল। মুসতানসিরিয়া মাদরাসা সেই সময়ের বাগদাদের ইসলামী জ্ঞান আহরণের বিশিষ্ট কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

এখানে চিকিৎসা, গণিত, সাহিত্য, ব্যাকরণ, দর্শন এবং ইসলামিক ধর্মীয় অধ্যয়ন সহ বিভিন্ন বিষয় শেখানো হতো। শিক্সার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইসলামিক আইন। এটি ছিল প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে চারটি মাজহাব—হানাফি, শাফেয়ী, মালেকি এবং হাম্বলি ফিকাহশাস্ত্র (ইসলামিক আইনশাস্ত্র) একটি ‘একীভূত বিদ্যালয়ে’ একত্রিত করে শেখানো হতো।

মুসতানসিরিয়া ছাত্রদের জন্য শিক্ষার পাশাপাশি বাসস্থান, পোশাক, খাবার এবং মাসিক ভাতা বা বৃত্তি প্রদান করত। শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক ভাতার ব্যবস্থা ছিল। মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনায় একজন প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হতেন এবং প্রবীণ শেখ ও ইমামরা এখানে শিক্ষকতা করতেন। মাদ্রাসাটিতে দার আল-হাদিস (হাদিস অধ্যয়ন) এবং দার আল-কোরআন (কোরআন অধ্যয়ন) এর মতো বিশেষ ইসলামিক জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান ছিল। একটি চিকিৎসা অনুষদ এবং ছাত্রদের অনুশীলনের জন্য একটি হাসপাতালও এই কমপ্লেক্সের অংশ ছিল। এছাড়াও, হাম্মাম, ঔষধালয়, খাদ্য সংরক্ষণাগার এবং রান্নাঘরসহ বিভিন্ন সুবিধা এখানে বিদ্যমান ছিল।

গ্রন্থাগার : মুসতানসিরিয়ার গ্রন্থাগারে ধর্ম, সাহিত্য, চিকিত্সা, গণিত, ইসলামিক আইন এবং বিজ্ঞানের সকল শাখার অমূল্য সংগ্রহ ছিল। খলিফা আল-মুসতানসির উদ্বোধনের দিনেই তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ দান করেন এবং রাজপ্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে ১৩০ গাধাবোঝাই বই এখানে স্থানান্তরিত হয়েছিল। প্রাথমিক সংগ্রহে ৮০ হাজার বই ছিল, যদিও কিছু বর্ণনায় এটি ৪ লাখ খণ্ডে উন্নীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা অতিরঞ্জিত হতে পারে। ১২৫৮ সালের মঙ্গোল আক্রমণ থেকে গ্রন্থাগারের সংগ্রহ টিকে থাকলেও, ১৩৯৩ সালে এটি আল-নিজামিয়ার মাদ্রাসার সাথে একীভূত হয়, যার সংগ্রহ পরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৫৩৪ সালের অটোমান আক্রমণের পর কিছু বই রাজকীয় গ্রন্থাগারে স্থানান্তরিত হয়।

স্থাপত্য এবং জলঘড়ি : মুসতানসিরিয়া মাদরাসার স্থাপত্য ছিল বাগদাদের ইসলামী স্থাপত্য বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এর বিন্যাস একটি চার-ইওয়ান পরিকল্পনা অনুসরণ করে, যা একটি দুই তলা আয়তাকার ভবনে একটি বড় উঠানের চারপাশে তৈরি হয়েছিল। এর অলঙ্করণে মুকারনাস, আরাবেস্ক এবং খোদাই করা ইটের কাজ দেখা যায়। ১২৩৫ সালে, মাদরাসার প্রবেশদ্বারে একটি স্মারক জল-চালিত অ্যালার্ম ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছিল, যা নামাজের ওয়াক্ত এবং দিন ও রাতের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করত।

পতন ও আধুনিক পুনরুদ্ধার : ১৩ শতকের পর, মাদরাসাটি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। ১২৫৮ সালের মঙ্গোল আক্রমণের ফলে মাদরাসার কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা পরে পুনরুদ্ধার করা হয়। তৈমুর লং কর্তৃক বাগদাদ দুইবার ধ্বংসের সময় (১৩৯২ ও ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে) মাদরাসাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর পাঠদান স্থগিত করা হয়। ১৫৮৯ সালে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালানো হলেও ১৬৩৮ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮শ শতাব্দীতে এটি সামরিক উদ্দেশ্যে এবং খান আল-মুওয়াসিলাহ নামে ব্যবসায়ীদের জন্য সরাইখানা হিসেবে ব্যবহূত হতো।

১৯৬০ সাল থেকে ইরাকি সরকার মাদ্রাসার এই কমপ্লেক্সটি পুনরুদ্ধার করা শুরু করে এবং এটিকে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে উন্মুক্ত করে। বর্তমানে ইরাকের পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং সংস্কৃতি মন্ত্রীর তত্ত্বাবধান করেন। আধুনিককালে এটি আল-মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত স্থাপনা হিসেবেও বিবেচিত।

সর্বশেষ সংবাদ

ইরানে আইএইএর পরিদর্শকদের ফেরার পথ খুলছে, আশাবাদী গ্রোসি

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি শুক্রবার ইরানে একটি কারিগরি প্রতিনিধি দলকে পরিদর্শনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে 'উৎসাহিত'...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ