‘পবিত্রতা’ শব্দটি আরবি ভাষায় ‘তাজকিয়া’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার একটি অর্থ হলো পরিশুদ্ধ করা, আরেকটি অর্থ হলো বৃদ্ধি বা উন্নতি। পরিভাষায়, আত্মার পবিত্রতা বলতে বোঝায় আত্মাকে যাবতীয় অপবিত্রতা, পাপ, মলিনতা, সীমা লঙ্ঘন এবং মানুষের সকল গর্হিত কর্ম ও অশুভ কথাবার্তা থেকে মুক্ত করে পরিশুদ্ধ করে তোলা। এই পবিত্রতা অর্জনের অর্থ হলো নিজেকে নিন্দনীয় গুণাবলি ও খারাপ স্বভাব থেকে মুক্ত করে গড়ে তোলা, এবং তার স্থানে উত্তম চরিত্র ও প্রশংসনীয় গুণাবলি দ্বারা নিজেকে অলঙ্কৃত করা।
আত্মাকে পবিত্র করার গুরুত্ব বোঝাতে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে পরপর ১১ বার শপথ করেছেন যা কোরআনের অন্য কোথাও দেখা যায় না। এরপর তিনি ঘোষণা করেন: ‘নিশ্চয়ই সে-ই সফল, যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আর সে-ই ব্যর্থ, যে একে কলুষিত করে।’ (সুরা শামস, আয়াত: ৯-১০)
এ আয়াত আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, সফলতা তাদেরই ভাগ্যে জোটে যারা অন্তরের হিংসা, বিদ্বেষ ও পাপাচার থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। পক্ষান্তরে, যারা নিজের নফসকে দুষিত করে, হিংসা ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা অবশেষে ব্যর্থতায় পতিত হয়। যেমন- হিংসা। হিংসা হলো অন্য কারো প্রাপ্ত সেৌভাগ্য, সফলতা বা আল্লাহপ্রদত্ত কোনো নিয়ামত তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা। হিংসা তখনই পূর্ণ রূপে প্রকাশ পায়, যখন কারো অন্তরে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ জাগ্রত হয় এবং সে তা প্রকাশে তত্পর হয়। প্রকৃতপক্ষে, শুধুমাত্র ‘চোখ’ দ্বারা হিংসা করার কাজ না; বরং, হিংসার প্রকৃত কারণ হলো হিংসাকারী ব্যক্তির অন্তরের অহংকার, হিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব। হিংসার পরিণতি কখনো কখনো শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই বিষয়ে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘বদনজর একটি বাস্তব বিষয়। যদি কোনো কিছু তাকদির (ভাগ্য) কে ছাড়িয়ে যেতে পারত, তাহলে তা হতো বদনজর। আর যদি কাউকে বলা হয় তুমি গোসল করো, তবে সে যেন গোসল করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৮৮)
এমনকি, হিংসাকারী ব্যক্তি যদি অন্ধও হয় তবু তার হূদয়ের হিংসা ও বিদ্বেষ অন্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, এই প্রভাব সরাসরি তার চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে নয়, বরং অন্তরের দুষ্টতা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যখন সে অন্যের কোনো নিয়ামত বা সেৌভাগ্যের কথা শুনে, তখনই তার অন্তরের হিংসা সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং সেই হিংসাত্মক শক্তি আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই কারণেই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আমাদের সতর্ক করে বলেন: ‘এবং হিংসুকের অনষ্টি থেকে(পানাহ চাই), যখন সে হিংসা করে।'(সুরা ফালাক, আয়াত : ৫)
তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের পাপ, সীমা লঙ্ঘন এবং হূদয়ের মারাত্মক ব্যাধি থেকে পবিত্র রাখা। এই আত্মিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আছে- হিংসা, কুদৃষ্টি, বিদ্বেষ ও অন্যের দোশ তালাশে লেগে থাকা। এই আত্মিক পবিত্রতার অন্যতম প্রধান উপায় হলো আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, নিয়মিত ইবাদতের মাধ্যমে আত্মাকে শক্তিশালী করা, ক্রমাগত ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই বিষয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন : ‘আর যারা আমার পথে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথসমূহে পথপ্রদর্শন করবো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সত্কর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৬৯)
আত্মার পবিত্রতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো নিজের দোষ ও দুর্বলতা স্বীকার করা, এবং মনে রাখা যে আমার মধ্যেও নিন্দনীয় কিছু গুণ আছে, যা সংশোধনের প্রয়োজন। যে ব্যক্তি নিজেকে সবসময় সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ মনে করে, সে অহংকারে পতিত হয় এবং আত্মশুদ্ধির পথ থেকে বিচু্যত হয়। আর প্রকৃত ধার্মিক সেই ব্যক্তি, যিনি বিনয়ী, আত্মসমালোচক এবং আত্মশুদ্ধির প্রতি যত্নশীল। রাসুল (সা.) আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন : ‘তোমাদের নম্নি স্তরে যারা রয়েছে তাদের দিকে তাকাও, আর যারা তোমাদের উপরে রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ো না; এতে তোমরা আল্লাহর নিয়ামতকে তুচ্ছ মনে করবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৩)
আত্মশুদ্ধির অন্যতম পথ হলো নিজের মধ্যে ভালো গুণাবলী বিকাশ করা, যতক্ষণ না তা সব নিন্দনীয় স্বভাবকে ছাপিয়ে যায়। এটি কেবল বাহ্যিক আচরণে নয়, বরং অন্তরের গভীর থেকে মন্দ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে অর্জন করতে হয়।
আত্মাকে হিংসা থেকে পবিত্র করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো আল্লাহর কোরআন ও তার জিকিরে মশগুল থাকা। বারবার কোরআন তিলাওয়াত করা, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং আল্লাহর জিকিরে নিজেকে সম্পৃক্ত করা আত্মার প্রশানি্ত ও কল্যাণের পথ খুলে দেয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন : ‘যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের হূদয় আল্লাহর স্মরণে প্রশানি্ত লাভ করে। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তর সত্যিকার প্রশানি্ত লাভ করে।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)
এই আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য আরো প্রয়োজন দানশীলতা ও উদারতা। কারণ দান শুধু গরিবকে সাহায্য করে না, বরং আত্মার পরিশুদ্ধ করে, হিংসা ও কৃপণতা দূর করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তাদের সম্পদ থেকে তুমি সদাকা (দান) গ্রহণ করো, যা তাদের পরিশুদ্ধ করবে এবং পবিত্র করবে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৩)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।