spot_img

তাপদাহ সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যা

অবশ্যই পরুন

গ্রীষ্ম ছিল একসময় প্রাচুর্যের ঋতু। অথচ আজ তার চেহারায় জ্বলছে উদ্বেগ। খরায় পুড়ে যাচ্ছে মাঠঘাট, দাবানলে ধ্বংস হচ্ছে বনানী, শহরের কংক্রিট যেন উত্তপ্ত চুল্লি। কেননা সূর্য যখন মাথার ওপর নিঃশব্দে জ্বলতে থাকে, বাতাস যখন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কুয়াশাহীন জ্বলন্ত দুপুরে। তখন শুধু শরীর নয়, আত্মাও ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘামে ভেজা কপাল, পানিশূন্য ঠোঁট আর বিদ্যুত্হীন রাত। সব মিলে প্রশ্ন জাগে যে, এই উষ্ণতা, এই ভয়ানক গ্রীষ্ম কি কেবল ঋতু পরিবর্তনের খেলা, না কি আমাদের সীমালঙ্ঘনের এক আসমানী প্রতিক্রিয়া?

এই প্রশ্নটি আর কেবল আবহাওয়ার বিষয় নয়। এটি একটি আত্মজিজ্ঞাসা। কারণ মানুষ শুধু প্রকৃতির ছায়ায় বসবাস করে না, সে প্রকৃতির ব্যবস্থাপকও। তার হাতে দেওয়া হয়েছে আমানত। তাই প্রকৃতি যখন বিদ্রোহী হয়, তখন কোরআনের পাতা খুলে দেখা ছাড়া আর উপায় থাকে না।

কোরআনের ভাষায়: দুর্যোগ কি আমাদেরই কর্মফল?
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের উপর যে বিপদ এসেছে, তা তোমাদের হাতের উপার্জনের কারণেই, আর তিনি অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা: ৩০)

অর্থাত্ আল্লাহ আমাদের পাপের সবটুকুর হিসাব করেন না। তিনি অধিকাংশ ক্ষমা করে দেন। কিন্তু কিছু সংকেত দেন। যাতে আমরা সচেতন হই, ফিরে আসি, সংশোধিত হই। তাই কখনো কখনো প্রকৃতির উত্তাপ আমাদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডেরই প্রতিফলন।

হাদিসের আলোকে: গ্রীষ্ম কি জাহান্নামের নিঃশ্বাস?
রাসূলুল্লাহ  (সা.) ইরশাদ করেন: ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের নিকট অভিযোগ করল: হে রব! আমার এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন আল্লাহ তাকে দুটি নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন। একটি শীতকালে এবং অন্যটি গ্রীষ্মকালে। যেটি তোমরা প্রচণ্ড গ্রীষ্ম অনুভব কর, সেটি জাহান্নামের নিঃশ্বাস।’ (বুখারি, হাদিস : ৩২৬০; মুসলিম, হাদিস : ৬১৭)

এই হাদিস স্পষ্ট করে দেয় যে, তাপদাহ কেবল একটি মৌসুমের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি আখেরাতের স্মরণ করে দেওয়ার একটি সংকেত। এটি এমন এক বাস্তবতা, যা ঈমানদার হূদয়কে জাগিয়ে তোলে। যেন সে ভাবে- এই উত্তাপে যদি আমি কষ্ট পাই, তবে জাহান্নামের আগুন কেমন হবে?

ইসলামী মনীষীদের দৃষ্টিতে: প্রকৃতি আল্লাহর সেনাবাহিনী
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন কোনো জাতিকে শিক্ষা দিতে চান, তখন তাঁর সৃষ্টি জগতকে মাধ্যম বানান— মেঘ, বাতাস, আগুন, পানি, সূর্য সবই আল্লাহর সেনাবাহিনী।’ (মাদারিজুস সালিকীন) এই কথার তাত্পর্য হলো, পৃথিবীর সব ঘটনা শুধু পদার্থবিদ্যার নিয়মে চলে না। কিছু কিছু হয় আত্মিক-নৈতিক নিয়মে। তাই গুনাহ বেড়ে গেলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়, আকাশ থেকে রহমতের বদলে আসে কঠোরতা।

বিজ্ঞান যা বলছে: দায় কি মানবজাতিরই?
আধুনিক বিজ্ঞান গবেষকেরা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করেন যে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা মূলত মানুষের কর্মফল। IPCC-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত ১০০ বছরে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর প্রধান কারণ শিল্প কারখানার ধোঁয়া, বন উজাড় করা, জীবাশ্ম জ্বালানির অপব্যবহার, প্লাস্টিক দূষণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, প্রতি বছর তাপপ্রবাহে পৃথিবীতে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত বাংলাদেশ ও ভারতে, এ মৃত্যু ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

সমাধান তাওবা ও পরিবর্তনে:
তাপদাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা ছোট, সীমিত এবং পরস্পর নির্ভরশীল। আমাদের কর্ম শুধু পৃথিবীতে নয়, আসমানেও প্রতিফলিত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন প্রকাশ্যে গুনাহ করতে শুরু করবে, তখন এমন দুর্যোগ তোমাদের উপর আসবে যা শুধু গুনাহকারীদের ওপর সীমিত থাকবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৮)

তাই আমাদের করণীয় হচ্ছে- নিজ নিজ গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করা, সমাজে নৈতিকতা ও পরিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনা, পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় হওয়া, দোয়া ও ইস্তিগফারের পরিমাণ বাড়ানো।

মনে রাখতে হবে যে, আকাশের নিচে এই জ্বলন্ত পৃথিবী আমাদের কাছে এক সতর্কবার্তা। যেখানে বলা হচ্ছে- হে মানুষ! থামো, ভাবো, ফিরে এসো। প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় না, কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নির্দেশে সে শিক্ষা দেয়। তাপদাহ তাই কেবল সূর্যের রোষ নয়, বরং এক আত্মিক দাগ, এক অন্তর্দৃষ্টির আহ্বান।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা এই যে, এই উত্তাপ যেন আমাদের অন্তরকে গলিয়ে দেয়, আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার পথ অবলম্বন করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। আমীন।

লেখক-  প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
saifpas352@gmail.com

সর্বশেষ সংবাদ

নতুন সিইও পেলো আইসিসি

আইসিসির প্রধান নির্বাহী (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাঞ্জোগ গুপ্তা। আজ সোমবার (৭ জুলাই) থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তিনি। আইসিসির...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ