কোরবানি মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ ও ঈমানি পরীক্ষার স্মারক। ইসলামের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি ইবাদতের পেছনে গভীর আধ্যাত্মিকতা ও সমাজকল্যাণ নিহিত থাকে। কোরবানিও এর ব্যতিক্রম নয়। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্মরণযোগ্য হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই দৃশ্য, যেখানে তিনি আল্লাহর নির্দেশে নিজ পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হন। আল্লাহ তাঁর এই আনুগত্য ও আত্মনিয়োগ দেখে সন্তুষ্ট হন এবং ইসমাইলের পরিবর্তে একটি পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সেই ত্যাগের স্মৃতি চিরস্থায়ী করে দেন। এটি ছিল মূলত আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণের এক চূড়ান্ত উদাহরণ।
ইসলামে তাই কোরবানি কেবল পশু জবাই নয়, বরং ঈমান ও তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর গোশত কিংবা রক্ত; বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭) অর্থাৎ কোরবানির মূল উদ্দেশ্য পশু হত্যা নয়; বরং নিজের নফস, লোভ, ভোগলালসা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে এক অন্তর যুদ্ধ।
অনেকে মনে করেন, কোরবানিতে অর্থ অপচয় হয়। অথচ তারা হয়তো জানেন না, এই ইবাদতের মাধ্যমে কী পরিমাণ সামাজিক কল্যাণ ঘটে। এটি এক ধরনের সুপরিকল্পিত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যার সুফল গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কোরবানির পশু জবাই হয়। এর একটি বড় অংশের গোশত দরিদ্র, মিসকিন, এতিম, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বছরের অধিকাংশ সময় যেসব মানুষ গোশতের স্বাদ পান না, ঈদের এই সময়ে তা তাদের ঘরে পৌঁছে যায়। ফলে এই উত্সব কেবল এক দিনের খুশির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি এক সমাজব্যাপী খাদ্যবণ্টন প্রক্রিয়ায় রূপ নেয়।
শুধু তাই নয়, কোরবানিকে ঘিরে পশু পালনকারী কৃষক, হাট ব্যবস্থাপক, পরিবহন শ্রমিক, কসাই, চামড়া শ্রমিকসহ লক্ষাধিক মানুষ সাময়িক কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ পান। এমনকি শহরের নিঃস্ব রিকশাচালক কিংবা গরুর রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দিনমজুরও আয় করতে পারেন এই উপলক্ষে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, কোরবানির মৌসুমে অন্তত ৫-৭ লাখ মানুষ অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ পান।
এ ছাড়া কোরবানির চামড়া বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের একটি বড় উত্স। বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আয় হয়। তাহলে এটা কি কেবল রক্তপাত? নাকি একটি বৃহত্ মানবিক সহমর্মিতার রূপ?
অনেকে জীবহত্যা ও পশুপ্রেমের কথা বলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারা বছর ধরেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে লাখ লাখ পশু জবাই হয় খাদ্যশিল্পের চাহিদা মেটাতে। সেই মাংস ছাঁকা হয় সুপার মার্কেটের বাক্সে, ব্যবহৃত হয় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুড চেইনে। সেখানে কোনো ‘নিষ্ঠুরতা’ বা ‘দুঃখপ্রকাশ’ শব্দ শোনা যায় না। অথচ একজন মুসলমান কোরবানির সময় খুশি মনে আল্লাহর নাম নিয়ে পশুকে দোয়া পড়ে জবাই করেন। এতে থাকে সম্মান, মায়া ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা।
আজ যারা ‘পশু হত্যা বন্ধ করো’ বলে সোচ্চার, তারা কি কখনো জবাই করা মুরগির দোকান বন্ধের দাবি তুলেছেন? বড় বড় গোশত কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন? না, তাদের দয়ার বান শোনা যায় কেবল মুসলমানদের কোরবানির সময়। এই দ্বৈত মানদণ্ড প্রমাণ করে, এটি বাস্তব পশুপ্রেম নয়; বরং ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ।
কেউ কেউ ‘ইবাদত বনাম মানবতা’ ধরনের বিভ্রান্তিক প্রশ্ন তোলেন। বাস্তবতা হচ্ছে, কোরবানির বিরোধিতা করে ‘এই অর্থ মানুষের সেবায় ব্যয় হোক’ বলা আসলে নতুন প্রজন্মকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার ছলচাতুরী। ধর্মীয় ইবাদতের পরিবর্তে মানবসেবার পরামর্শ শুনতে উদারতা মনে হলেও, এটি মূলত এক নব্য বস্তুবাদী চিন্তা, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের উপাস্য হয়ে ওঠে। ইসলাম ইবাদত ও মানবতার মধ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি করেনি; বরং প্রকৃত ইবাদতের মাধ্যমেই মানবতা বাস্তবায়িত হয়।
কোরবানি কোনো পশুহত্যা উত্সব নয়। এটি আত্মিক উন্নয়ন, মানবিক সহমর্মিতা ও আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসার এক বার্ষিক পাঠ। যারা কোরবানির সমালোচনা করেন, তারা হয়তো এটিকে বোঝেননি, কিংবা বুঝেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অথচ এই ইবাদতের মাধ্যমেই সমাজে সাম্য, ত্যাগ ও তাকওয়ার যে চর্চা হয়, তা অন্য কোনো মানবতাবাদী চিন্তাধারায় কল্পনাও করা যায় না।
মানবতার প্রকৃত চেহারা তখনই ফুটে ওঠে, যখন মানুষ নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে উপলব্ধি করে। আর কোরবানি সেই উপলব্ধিরই এক অনুপম প্রতীক। তাই প্রশ্ন নয়, বলা উচিত, কোরবানি মানেই মানবসেবার সেরা রূপ।