ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হলো হজ। এ একটি মহিমান্বিত ইবাদত, যেখানে বান্দা তার প্রভুর নিকট দাসত্বের পূর্ণ প্রকাশ ঘটায়। হজের প্রকৃত রূপ ও পদ্ধতি বোঝার জন্য আমাদের সামনে আদর্শ হয়ে আছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাঁরই (রাসুলের) অনুসরণ করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৯)
আর এই অনুসরণ হজের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। নিম্নে মহানবী (সা.)-এর হজের পদ্ধতি ও কার্যাবলী কেমন ছিল তা তুলে ধরা হলো—
নবী করিম (সা.)-এর ইহরাম গ্রহণ
এ হজ ছিল শুধু একটি ইবাদতের পরিপূর্ণতা নয়; বরং ছিল এক মহাপাঠ, এক জাগরণ, যেখানে মানবজীবনের শুদ্ধতা, তাওহিদের পরিপূর্ণতা এবং নববী শিক্ষার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বাস্তবায়ন প্রকাশ পেয়েছিল। এ হজের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি নির্দেশ ছিল এক অনুপম পাথেয়, যার আলোতে যুগে যুগে উম্মত খুঁজে পেয়েছে পথের দিশা।
এই মহিমান্বিত হজযাত্রার সূচনা হয়েছিল জিলকদ মাসের ২৫ তারিখে, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা মুনাওয়ারা থেকে হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তবে তার এই যাত্রা ছিল না কোনো সাধারণ সফর। এটি ছিল এক প্রশিক্ষণমূলক অভিযান—শুধু তার সাহাবিদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য।
হজের প্রস্তুতির প্রাক্কালে, তিনি সাহাবিদের সামনে দাঁড়িয়ে এক হূদয়ছোঁয়া খুতবা প্রদান করেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করেন—ইহরাম গ্রহণকারী কী পরিধান করবে, কীভাবে ইহরামে প্রবেশ করবে, কোন আচরণে থাকবে, এবং কী থেকে বিরত থাকবে। সেই খুতবা যেন ছিল ইবাদতের আধ্যাত্মিক রূপরেখা, যা শুধু শরিয়তের শিষ্টাচার নয়, বরং অন্তরের পরিশুদ্ধির এক গভীর আহ্বান।
এরপর নবীজি (সা.) যাত্রা করেন জুলহুলাইফার দিকে—যা বর্তমানে ‘আবিয়ার আলী’ নামে পরিচিত। সেখানে তিনি একরাত্রি অবস্থান করেন। পরদিন তিনি গোসল করেন—যেন এক আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতার প্রতীকস্বরূপ। তারপর তিনি দুই খণ্ড সাদাসিধে কাপড় পরিধান করেন—যা পরিচয়ের ভেদাভেদ ঘোচানো, দুনিয়াবি আভিজাত্য ত্যাগ করার এক নিঃশব্দ ভাষ্য। এরপরই তিনি উচ্চারণ করেন সেই মহাজাগরণের ঘোষণা ইহরামের নিয়ত। ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকেই সাড়া দিয়ে হাজির হচ্ছি হজের নিয়তে।’ (সুবুলুল হুদা ওয়াল রাশাদ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা : ৪৬১)
এই উচ্চারণ ছিল শুধুমাত্র একটি নিয়ত নয়, বরং ছিল এক প্রেমময় প্রতিশ্রুতি—আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণের, নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার, দুনিয়ার মোহ কাটিয়ে চিরন্তন অনন্তের দিকে ধাবিত হবার।
এই ইহরাম ছিল শুধু দুটি কাপড় নয়, ছিল দুনিয়ার বস্ত্র খোলার, অহংকার ঝেড়ে ফেলার, কেবল একক স্রষ্টার সামনে নিজেকে এক বিনীত বান্দারূপে উপস্থাপন করার মহান কর্ম।
সেই দিন থেকে আজও কোটি কোটি মুসলমান যখন হজে গমন করে, তখন তারা এই ইহরামের মধ্য দিয়েই প্রবেশ করে সেই মহাসম্ভারের স্মৃতিতে—যেখানে একদিন মহানবী (সা.) দাঁড়িয়েছিলেন, দুনিয়ার সব মর্যাদা ভুলে একমাত্র রবের সামনে হাজিরা দিয়েছিলেন। (আস-সিরাতুন নাববিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ৬৫৯)
আরাফার দিন নবীজির হজযাত্রার পবিত্র অধ্যায়
হজের মহান সফরে নবী করিম (সা.)-এর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল একেকটি দীপ্তিময় দিকনির্দেশনা। জিলহজের নবম দিন, যাকে ইয়াওমু আরাফাহ বলা হয়, সেই দিনটি ছিল এই সফরের চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক শিখর। সে দিন সকালে, আরাফার প্রান্তরে নামিরাহ নামক স্থানে প্রিয়নবীর জন্য একটি তাঁবু টাঙানো হয়। সেখানেই তিনি উম্মতের উদ্দেশ্যে প্রদান করেন এক অসাধারণ, হূদয়স্পর্শী, বোধসমৃদ্ধ খুতবা—যা ইতিহাসে ‘খুতবাতুল বিদা’ নামে স্মরণীয় হয়ে আছে।
এই খুতবায় তিনি মানবতার সার্বজনীন বার্তা দেন, নারীর অধিকার, মানুষের রক্ত ও সম্মানের মর্যাদা, উম্মাহর ঐক্য এবং আল্লাহর তাওহিদের গুরুত্ব ঘোষণা করেন। এরপর তিনি জোহর ও আসরের নামাজ একসাথে আদায় করেন ‘জামে তাকদিম’ পদ্ধতিতে। (সিরাতে খাতামুন নাবিয়্যিন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৬৮৮)
এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) আরাফার ময়দানে উপস্থিত হয়ে কেবলামুখী হয়ে হাত তোলে করুণ মিনতির মাধ্যমে আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন করেন। সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন দোয়া, জিকির, কান্না ও বিনয়-বিনম্রতায় পরিপূর্ণ—যেন এক বান্দা নয়, সমগ্র মানবতার প্রতিনিধি হয়ে প্রভুর দরবারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তিনি যাত্রা করেন মুজদালিফার দিকে—গাম্ভীর্য ও ধৈর্যের সঙ্গে। সেখানে পৌঁছে তিনি এক আজান ও দুই ইকামতের মাধ্যমে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন ‘জামে তাখির’ পদ্ধতিতে। রাতটি তিনি মুজদালিফায় কাটান, সেখানে বিশ্রাম নেন, এবং ফজরের নামাজ আদায় করেন। (আস-সিরাতুন নাববিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ৬৮৯)
দশম জিলহজ ও তাশরিকের দিন : ত্যাগ, তাকওয়া ও আনুগত্যের প্রতীক
ঈদের পবিত্র সকালে, নবী করিম (সা.) মুজদালিফা থেকে ‘মাশআরুল হারাম’ নামক স্থানে উপস্থিত হন। কেবলামুখী হয়ে তিনি দোয়া করেন, তাহলিল, তাকবির ও তাওহিদের উচ্চারণে ভরে ওঠে বাতাস—এক অনন্য বন্দেগির দৃশ্যপট।
এরপর তিনি মিনায় পৌঁছে জামরাতুল আকাবা—বড় জামরায় প্রথমে ‘রমি’ করেন, সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন এবং প্রতিটি নিক্ষেপে উচ্চারণ করেন ‘আল্লাহু আকবার’। এরপর তিনি কোরবানি করেন, তাঁর হাদি (পশু) জবাই করেন, এবং ইহরাম থেকে হালাল হয়ে স্বাভাবিক পোশাকে ফিরে আসেন।
এরপর তিনি মক্কা মুকাররমায় ফিরে যান, সেখানে ‘তাওয়াফুল ইফাজাহ’ সম্পন্ন করেন এবং জোহরের সালাত আদায় করেন। যেহেতু তিনি আগেই কুদুমের সময় ‘সাঈ’ করেছেন, তাই সাফা-মারওয়া সাঈ করেননি। (সুবুলুল হুদা ওয়াল রাশাদ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা : ৪৬৪)
এরপর তিনি আবার মিনা ফিরে আসেন এবং তাশরিকের তিন দিন—১১, ১২, ও ১৩ জিলহজ প্রতিদিন তিনটি জামরায় (ছোট, মাঝারি ও বড়) কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। তবে প্রতিদিন ছোট ও মাঝারি জামরা নিক্ষেপের পর তিনি দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, কান্না করেন, বিনীতভাবে প্রার্থনা করেন।
তাশরীকের শেষ দিন, অর্থাত্ ১৩ জিলহজ, তিনি আল-মুহাসসাব নামক স্থানে অবস্থান করেন এবং জোহরের নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি বাইতুল্লাহ ফিরে যান, বিদায়ী তাওয়াফ (তাওয়াফুল বিদা) আদায় করেন, এবং পরদিন ফজরের নামাজ পড়ে—এই আলোকোজ্জ্বল, হূদয়গ্রাহী হজযাত্রা শেষ করে মদিনা মুনাওয়ারার পথে যাত্রা করেন। (সুবুলুল হুদা ওয়াল রাশাদ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৭১)
বিদায় হজ : রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবনের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা
মানবজাতির ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো কেবল একটি ঘটনার বর্ণনা নয়, বরং হয়ে ওঠে এক চিরন্তন আদর্শের স্মারকচিহ্ন। ১০ হিজরির বিদায় হজ তেমনই এক মহিমান্বিত অধ্যায়। এটি ছিল আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের প্রথম এবং শেষ হজ—যা শুধু একটি ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং ছিল একটি আধ্যাত্মিক বিপ্লব, মানবতার সর্বোচ্চ আহ্বান এবং চূড়ান্ত নবুয়তের অবিনাশী বার্তা। (আস-সিরাতুল হালবিয়্যাহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ২৯৩)