রমজান মাস বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এই মাসকে তিনি অপার মহিমায় মহিমান্বিত করেছেন। এই মাসকে তিনি বান্দার জন্য বরকতময় করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের ওপরে আল্লাহ তাআলা এই মাসের রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসের আগমনে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ি পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত আছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২১০৬)
বরকতের পরিচয়
বরকতের শাব্দিক অর্থ প্রবৃদ্ধি ও প্রাচুর্য। সাধারণত কোনো ইতিবাচক বিষয়ে প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতিকে বরকত বলা হয়। ইমাম রাগেব ইস্পাহানি (রহ.) বরকতের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, কোনো বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকে বরকত বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ যে জিনিসে যে কল্যাণ রেখেছেন সে কল্যাণ অর্জন করাকেই বরকত লাভ করা বলে। (লিসানুল আরব : ১০/৩৯৫; আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কোরআন, পৃষ্ঠা ১১৯)
রমজানের বরকত কি
ইমাম রাগেব ইস্পাহানি (রহ.)-এর সংজ্ঞা অনুসারে রমজান মাসে আল্লাহ যেসব কল্যাণ রেখেছেন সেগুলোই রমজান মাসের বকরত। যে ব্যক্তি এসব কল্যাণ অর্জন করতে পারবে সেই রমজানের বরকত অর্জন করতে পারবে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এমন কয়েকটি কল্যাণ হলো—
১. আল্লাহর ক্ষমা : আল্লাহ রোজাদারের জন্য ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন, পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্য আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ ও রোজা পালনকারী নারী, লজ্জাস্থান সংরক্ষণকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থান সংরক্ষণকারী নারী, আল্লাহকে বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও বেশি স্মরণকারী নারী—এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৫)
৩. আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি : রমজান মাসে আল্লাহ আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করেন। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এই মাসে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ নৈকট্য অনুসন্ধান করবে তাকে অন্য মাসের ফরজের সমান সাওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায়ের সাওয়াব পাবে। এই মাস ধৈর্যের মাস এবং এই মাসে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়।’ (সুনানে বায়হাকি)
৪. দোয়া কবুল হওয়া : পূর্বসূরী আলেমরা রমজান মাসকে দোয়ার মাস বলেছেন। কেননা রমজান মাসে দোয়া কবুলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৫২)
যেভাবে বরকত লাভ করব
১. কোরআন তিলাওয়াত : আল্লাহ পবিত্র কোরআনকে বরকতময় বলেছেন। তাই কোরআন তিলাওয়াত ও তা অনুসরণের মাধ্যমে বরকত লাভ করা সম্ভব। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা বরকতময়। সুতরাং তার অনুসরণ কোরো এবং সাবধান হও, তা হলে তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫৫)
২. কদরের রাত অনুসন্ধান করা : আল্লাহ কদরের রাতকে বরকতময় করেছেন এবং এই রাতকে হাজার রাতের চেয়ে উত্তম বলেছেন। তাই কদরের রাত অনুসন্ধানের মাধ্যমে রমজান মাসের বরকত লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী।’ (সুরা দুখান, আয়াত : ৩)
৩. মসজিদে সময় কাটানো : আল্লাহ সাধারণভাবে মসজিদকে বরকতময় করেছেন। আর বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন তিনটি মসজিদকে। তা হলো, মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। তাই রমজানে সম্ভব হলে উল্লিখিত তিন মসজিদে সময় কাটানো। আর তা হলে নিজ নিজ এলাকার মসজিদে সময় কাটানো। ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ১)
৫. ইস্তিগফার করা : পাপ থেকে তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর বরকত লাভ করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, আমি বলিয়াছি, তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা প্রার্থনা কোরো, তিনি তো মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করিবেন, তিনি তোমাদিগকে সমৃদ্ধ করিবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করিবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করিবেন নদী-নালা।’ (সুরা নুহ, আয়াত : ১০-১২)
৬. ব্যবসায় সততা অবলম্বন করা : সততার সঙ্গে ব্যবসা করলে আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা (একে অপরের সাথে) বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের উভয়ের ইখতিয়ার থাকবে। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে ও (পণ্যের দোষ-ত্রুটি) যথাযথ বর্ণনা করে তবে তাদের কেনাবেচায় বরকত হবে, আর যদি তারা মিথ্যা বলে ও (ত্রুটি) গোপন করে, তবে তাদের কেনা বেচার বরকত নষ্ট হয়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১১০)
৭. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা : আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৬৭)
৮. বরকতের দোয়া করা : মুমিন বান্দা দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর বরকত লাভ করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে বরকত লাভের দোয়া করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে মৌসুমের প্রথম ফল রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেওয়া হত। তিনি তখন বলতেন : ‘হে আল্লাহ! আমাদের মদিনায়, আমাদের ফলে, আমাদের মুদে ও আমাদের সা-তে বরকত দান করুন, বরকতের ওপর বরকত দান করুন। অতঃপর তিনি ফলটি তাঁর কাছে উপস্থিত সবচেয়ে শিশুকে দিয়ে দিতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩২২৬)
আল্লাহ সবাইকে রমজানের বরকত দান করুন। আমিন।