মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, গত ১১ বছরে সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৩৪৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে ৩২ জন, ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৫, ২০১৯ সালে ৪৩, ২০২০ সালে ৪৯, ২০২১ সালে ১৮, ২০২২ সালে ২৩, ২০২৩ সালে ৩১, ২০২৪ সালে ৩০ জন নিহত হন৷ আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুই জন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে একজন নিহত হয়েছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, ‘বিএসএফ যেভাবে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করছে তা আসলে কোনো ভালো বার্তা দেয় না। এটা সুসম্পর্কের বার্তা দেয় না৷ তারা এটা বার বার বন্ধের কথা বলেও কথা রাখছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দরকার এখন দক্ষতার সঙ্গে এটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে ডিল করা৷ এটা সম্পর্ক উন্নয়নের শর্ত হিসাবে নিয়ে কাজ করা৷ তাদের ওপর আর্ন্তজার্তিক চাপ সৃষ্টি করা।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের যোগাযোগ আছে৷ চলাচল আছে। তারা চোরাচালানের কথা বলে। সেটা সত্য ধরে নিলেও চোরাচালানের শাস্তি তো গুলি করে হত্যা নয়৷ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত আছে৷ সেখানে তো তারা এভাবে হত্যা করে না। আর ভারতের ভিতর থেকেইতো গরু আসে৷ সেই গরু কেন আটকানো হয় না৷ আসলে এই হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়৷ আতঙ্কে রাখতে চায়।’
সবশেষ নিহতের ঘটনা
সীমান্তে সবশেষ নিহত হওয়া বাংলাদেশির নাম আল আমিন (৩০)। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের বাসিন্দা৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পুটিয়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে তিনি নিহত হন। আল আমিন পুটিয়া গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে৷ তাদের বাড়ি সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০০ গজ ভেতরে।
আল আমিনের পরিবারের দাবি, সন্ধ্যার একটু পরে গোয়াল থেকে গরু ছুটে সীমান্তের দিকে গরু আনতে গেলে বিএসএফ শূন্য রেখায় তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আল আমিন ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তার এক ভাই সেনাবাহিনী এবং এক ভাই পুলিশে চাকরি করেন। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামে থেকে কৃষি কাজ করত৷ মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছিলো। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।
কসবা থানার সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘তাদের বাড়ি সীমান্তের একদম কাছে হওয়ায় সেখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ঘটনার পর এখনো কোনো মামলা হয়নি। আমি প্রাথমিক তদন্ত করতে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ ওই এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে। নিহত তরুণকে এলাকায় সবাই ভালো বলেই জানে। কোনো খারাপ রিপোর্ট আমি পাইনি। সে ছুটে যাওয়া গরুই আনতে গিয়েছিল।’
‘অনেকেই মামলা করে না’
মামলার ব্যাপারে কসবা থানার সাব-ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে অনেক পরিবারই মামলা করে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে৷ আর মামলা করলেও তো বিচারের কোনো সুযোগ নেই।’
গত বছরের ডিসেম্বরে পঞ্চগড়ের ভারতীয় মমিনপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আনোয়ার হেসেন (৩৫)। গরু ব্যবসায়ী আনোয়ার জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের আমজুয়ানী এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। তার ভাই আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো মামলা করিনি৷ মামলা করে কী হবে? এর তো বিচার পাওয়া যায় না।’
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী এবং একটি শিশু সন্তান আছে্তা রা কীভাবে চলছেন জানতে চাইলে ভাই আরিফুর রহমান বলেন, ‘আল্লাহ চালায়।’
‘বিচার হলে হয়তো হত্যাকাণ্ড কমতো’
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানি। তার লাশ অন্তত পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। সেই ছবি দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে্ফে লানি হত্যার ১৩ বছর পর স্বর্ণা হত্যা নিয়েও তোলপাড় কম হয়নি। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর রাতে মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ-এর গুলিতে কিশোরী স্বর্ণা দাস (১৪) নিহত হয়।
ঢাকায় শহীদ মিনারে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ফেলানি হত্যার ১৪ বছরকে সামনে রেখে ৭ জানুয়ারি সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবিতে গণজমায়েত আয়োজন করে। ফেলানির বাবা নুর ইসলাম ও মা জাহানারা বেগমও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ফেলানি হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফেলানির মা।
ফেলানির মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তান হত্যার বিচার হলে হয়তো সীমান্ত হত্যা বন্ধ হতো।’ আর ফেলানির বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ১৪ বছর ধরে আমার সন্তানের জন্য কাঁদছি। কোনো বিচার পাইনি৷ বিচারের জন্য ভারতেও গিয়েছি৷ কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
আমার মেয়েকে হত্যার পর অনেক আলোচনা হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি৷ এর কারণ বিচার না হওয়া৷ বিচার হলে হয়তো এটা কমতো,’ বলেন তিনি।
প্রতিশ্রুতির পরও হত্যা বন্ধ হয়নি
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় আনতে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সীমান্তে যত বাংলাদেশি নাগরিক বিএএসএফের হাতে নিহত হয় তার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আসলে সীমান্তে ভারত যা করছে তা নতুন নয়৷ গত ১৫ বছরে বিএসএফ সীমান্ত হত্যা চালিয়েছে৷ কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে৷ তখন সরকার কিছু বলেনি৷ বাংলাদেশের সীমান্তে এখন একটা অস্থির পরিস্থিতি দেখাতে চায় ভারত৷ এটা নিয়ে তার রাজনীতি আছে।’
জবাব দেওয়ার পরামর্শ
সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশকে আসলে কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান। তার কথা, ‘জবাবটা ঠিক মতো দিতে হয়৷ তারা যেরকম আচরণ করবে আমাদের ঠিক একই আচরণ করে জবাব দিতে হবে৷ এটা তো আর প্রকাশ্যে বলা যায় না৷ এটা কানে কানে জানিয়ে দিতে হয়।’
১৯১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি বিজিবিতে ছিলেন। তার সেই অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘আসলে এটা একটা অভ্যাস। তারা হত্যা করতে করতে সেটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। টেকনিকটা হলো, তাদের আপনি যখন একই কাউন্টার দেবেন তখন তারা থেমে যাবে৷ আমার সময়ে কয়েকটি সীমান্তে এটা করে ফল পেয়েছিলাম।’
‘বাংলাদেশ ভারতের দীর্ঘ সীমান্তে এমনও আছে যে বাড়ি বাংলাদেশে, উঠান ভারতে৷ দুই দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিয়ে হয়্আ মি এরকম বিবাহিত দম্পতিদের পরিবারকে সীমান্তে দেখা করার ব্যবস্থাও করেছি। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে তা হলো ভারত আমাদের সীমান্ত হত্যার মাধ্যমে দমাতে চায়।’
‘মারা যাওয়াদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভারতীয়’
এদিকে, বিএসএফ এর হাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভারতীয়, আর ২০ শতাংশ বাংলাদেশি বলে ডিডাব্লিউকে জানান কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ বা মাসুম-এর সম্পাদক কিরীটী রায়৷ তিনি বলেন, ‘যাদের রক্ষা করার জন্য বিএসএফ, তারাও আক্রান্ত৷ তাই সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন বন্ধে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
কিরীটী রায় বলেন, বাংলাদেশে পট পরিবর্তনের পর ভারতের সাধারণ মানসিকতায় বাংলাদেশ নিয়ে যে পরিবর্তন দেখা গেছে, কিংবা ওপর থেকে দেখা গেছে সেটার প্রভাব সীমান্তে পড়ছে না তা বলা যায় না৷ আগের চেয়ে বরং নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে বলা যায়।