ইসলামি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সরোবরের গভীর অতলান্ত পদ্ম, ইলম, আমল এবং অধ্যাবসায়ের আকাশের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম আবু হানীফা (রহ.), আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। ইসলামের ইতিহাসে তিনি এমন এক মহামনীষী, যাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দীপ্তি আজও আলো ছড়ায়। তাঁর অসামান্য বুদ্ধিমত্তা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ফিকহি ব্যুত্পত্তির কথা শুধু তাঁর অনুসারীরা নয়, বরং তাঁর সমালোচকরাও অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারী হাদীসশাস্ত্রের প্রাণপুরুষ ইমাম ইবনুল আসির আল জাযারী (রহ.) বলেন, যদি আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর বিশদ বিশ্লেষণ করি, তাহলে বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে; আর আমরা এ মহিমা কীর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। কেননা তিনি ছিলেন আলেম, আখলাকে নববীর মূর্তপ্রতীক ও বাস্তব নমুনা। ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় অনুশাসনের অতি যত্নশীল অনুসারী, দুনিয়া নির্মোহচিত্ত, (অতি উচ্চ মার্গের) ইবাদতগুজার, খোদাভীরু ও মুত্তাকী এবং ইলমে শরীয়তের গ্রহণযোগ্য ইমাম। (জামিউল উসুল ফি আহাদিসির রাসুল, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা: ৯৫২)
ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহ সংকলনের দুরূহ ও বিশাল কর্মযজ্ঞ, অসংখ্য ছাত্রের শিক্ষা-প্রদান, সমাজের নানাবিধ জটিল প্রশ্নের সমাধানের এসব বৈচিত্র্যময় ব্যস্ততার ভেতরেও কোরআনের সঙ্গে তাঁর যে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা ঈমান ও ইখলাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে তাঁর আত্মত্যাগ, সংযম ও ইবাদতের যে দৃষ্টান্ত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে, তা বিস্ময়কর ও অনুকরণীয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রমজানের প্রতিদিন ও প্রতি রাতে পূর্ণ একবার করে কোরআন খতম করতেন। সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত দিনের বেলা একবার, আর ইফতার থেকে সাহরির আগ পর্যন্ত রাতে আরেকবার। তিলাওয়াতের প্রতি এই অপরিসীম ভালোবাসা যেন তাঁর আত্মার খোরাক ছিল। (তারীখুল ইসলাম, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা: ৩০৯)
শুধু রমজান মাসেই নয়, ঈদুল ফিতরের আনন্দঘন রাত ও দিনেও তিনি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেন। ঈদের খুশির মধ্যেও তাঁর হূদয় আল্লাহর কালামের সুধা পান করতে ব্যাকুল থাকতো। এইভাবে পূর্ণ রমজান মাসের মধ্যে তিনি মোট বাষট্টি (৬২) বার কোরআন খতম করতেন। এমন এক বিস্ময়কর কোরআনপ্রেমিক, যা তাঁর ঈমানি উচ্চতা ও আত্মিক বিশুদ্ধতার এক জাজ্বল্যমান সাক্ষী। (আখবারু আবি হানিফা ওয়া আসহাবিহি, পৃষ্ঠা: ৫৫)
এ বিষয়ে তাঁর প্রিয় শাগরিদ ও প্রসিদ্ধ ফকিহ, ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) নিজেই বর্ণনা করে বলেন: ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রতিদিন ও প্রতি রাতে একবার করে কোরআন খতম করতেন, আর যখন রমজান মাস আসতো, তখন ঈদুল ফিতরের রাত ও দিনসহ তিনি মোট বাষট্টি (৬২) বার কোরআন খতম করতেন। (মানাকিবুল ইমাম আবি হানিফা ওয়া সাহিবাইহি, খণ্ড ১,পৃষ্ঠা: ২১)
সুবহানাল্লাহ! এ যেন কোরআনের সঙ্গে এক অটুট বন্ধন, ইলম ও আমলের এক অপূর্ব সমন্বয়, যা আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এই প্রেমময় বন্ধন আমাদের শেখায়, ইলম যদি আত্মাকে আলোকিত না করে, ইবাদতে যদি ইখলাসের স্রোত না বয়ে যায়, তবে সে ইলম পূর্ণতা পায় না। আল্লাহর কালামের সঙ্গে হৃদয়ের এই নিবিড় সম্পর্কই তাঁকে ফিকহ ও ইলমের আকাশে ধ্রুবতারা বানিয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরও এই পবিত্র রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন পড়া ও খতম করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহর, চট্টগ্রাম।