মোবারক হোসেন, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের দুর্গম চর চৌহালী থেকে মামলার হাজিরা দিতে রওনা দেন। নদী পথে সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই চলে গেছে ৩ ঘণ্টা। তারপর ভ্যানে করে আদালতের উদ্দেশে যাত্রা। সবমিলিয়ে আদালত পাড়ায় পৌঁছাতেই লেগে গেলো ৪ ঘণ্টা। ততক্ষণে আবারও পিছিয়েছে শুনানির তারিখ।
আদালত পাড়ায় দেখা হয় হোসনে আরা নামের আরেক নারীর সাথে। পারিবারিক কলহের মামলা নিয়ে হোসনে আরা ঘুরছেন ৩ বছর ধরে। শুনানি হচ্ছে না, মিলছে কেবল তারিখের পর তারিখ।
এক জমির মামলায় ২ বছর ধরে শুধু হাজিরা দিতে দিতে কাহিল আলী আরশাদ নামের এক বৃদ্ধ ও তার ভাইয়েরা। শেষমেষ সমঝোতায় নিষ্পত্তি করে নেন।
৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে চলা জমি-জমার এমন বহু মামলা এখনও অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন।
সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজমুল হক বলেন, বাদি-বিবাদী মারা গেছেন। এরপর পরবর্তী প্রজন্ম এসেছে। তাতেও সমাধান আসেনি। তারপর আরেক প্রজন্ম এসেও মারা গেছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
যখন একটি মামলায় একজন ব্যক্তি বা পরিবার জড়িয়ে যায়, তখন কখন যে দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, কখনও তা এক যুগ পর্যন্ত চলে যায়, তা শুধু বিচারপ্রার্থীরা জানেন। দেশের প্রতিটি অধস্তন আদালতের বারান্দায় গেলে মিলবে এসবের দৃশ্য। ভোগান্তির পাশাপাশি তাদের চেহারায় অপেক্ষা ও আক্ষেপ থাকে।
বিচারে কেন এত বিলম্ব? নানান অভিজ্ঞতার কথা জানান বিচারিক আদালতের আইনজীবীরা।
সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইন্দ্রজীৎ সাহা বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যায় না, ফোন দিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসে। এখন তো মামলার সাথে তাদের মোবাইল নাম্বার থাকে। বাদীকে বলে সাক্ষী নিয়ে আসতে। সাক্ষী নেয়, আবার হয়তো আজকে না কালকে আসো, এভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
একই আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রফিক সরকার বলেন, আইনজীবী হয়তো চাচ্ছে বা তার অবহেলা আছে, আবার বিচারক যিনি আছেন উনারও হয়তো থাকতে পারে, আবার চিকিৎসক যিনি সাক্ষী আসতেছে না, আবার পুলিশ সাক্ষী দিতে আসছে না, দূর দূর থেকে সাক্ষী নিয়ে আসা লাগে— সবমিলিয়ে প্রক্রিয়া দেরিতে গড়ায়।
দ্রুত বিচারের জন্য ৯০ দিন বা ১৮০ দিনের সময় বেধে দেয়া আছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলোতে। সেখানেও বহু মামলা শেষ হতে কেন বছর চলে যায়?
এ নিয়ে অ্যাডভোকেট রফিক সরকার বললেন, যদি ৯০ বা ১৮০ দিনের মধ্যে এগুলো শেষ করতে না পারি, তারপর আর কোনো কথা লেখা নেই। যার ফলে ওই সুযোগটা নিয়ে বিচারকরা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে যাচ্ছে।
অধস্তন আদালতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও খরচ কমাতে করণীয় ঠিক করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা তৈরির এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। ভোগান্তি কমাতে কমিশনের কাছে আইনীজীবীদের কী পরামর্শ?
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন বললেন, কারাগারে যদি একটা অনলাইন সিস্টেম করা হয়— যেমন কোন কোন আসামির আজ মামলার হাজিরা, আসামি আদালতে উপস্থিত আছে কি না। অনেক সাক্ষী আসতে ভয় পায়। অনেক ভুক্তভোগী সাক্ষী দিতে আসতে ভয় পায়। তাদেরকে যদি ইফেক্টিভভাবে আনার ব্যবস্থা করা হয় অথবা জুমের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় বা বিভিন্ন থানায় তারা আছে, ওই থানার মাধ্যমে যদি তাদের সাক্ষ্য নেয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
সিরাজগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, বিচার বিভাগ আলাদা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হলে আমাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার আশা করতে পারে।
মোদ্দা কথা, বাদী কিংবা বিবাদী আদালতের বারান্দায় বসে এজলাসের দিকে বিচারপ্রার্থীদের থাকে অপলক দৃষ্টি। সংস্কার কমিশনের কাছে তাদের চাওয়া, দ্রুত ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা।