অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘বিপ্লবের মাধ্যমে আসা একটা সরকার তার ম্যান্ডেট নিয়ে মোটেও চিন্তিত ন।’ তিনি বলেন, ‘সে (সরকার) জানে তার ম্যান্ডেটটা কী।’
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর খামার বাড়ি কৃষি ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘ঐক্য সংস্কার নির্বাচন, জাতীয় সংলাপ-২০২৪’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ এর আয়োজন করে।
৫ আগস্টের ঘটনা তুলে ধরে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, ‘সাহসিকতা আর তারুণ্য একসাথে জড়িত। আমাদের অনেক সাহিত্য, গল্প, কবিতা আছে। আমার মনে হয়, সাহসিকতা কী জিনিস এবার আমরা জুলাই-আগস্টের আন্দোলন থেকে বুঝেছি। আমরা কিন্তু এরশাদের আমলে আন্দোলন করেছিলাম, তবে এ পরিমাণ সাহসিকতা দেখাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ছকে ফেলানো একটি রাজনীতি বদলানোর চেষ্টা করি, সমঅধিকারের কথা বলি, আমরা যদি বৈষম্য ভাঙ্গানোর কথা বলি, এ যাত্রা কোনোদিন সহজ হবে না। কোনোদিনও সহজ হওয়ার কথা নয়। সব সময় একটা কঠিন রাস্তার ভিতর দিয়ে আমাদেরকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে ধৈর্যটা রাখতে হবে। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি। প্রথাগতভাবে চলে আসা জিনিসগুলো একদিনে ভাঙবে না।’
সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের যে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, এখানে আমাদের বুঝতে হবে, কোন বিষয়ে ঐক্য চাই। প্রচুর বিষয়ে আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ঐক্য প্রয়োজন, রাজনীতির জন্য ঐক্যের প্রয়োজন। আমাদের তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয় সেটার জন্য ঐক্য প্রয়োজন।’
সংস্কার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যিনি যে বিষয়ে কাজ করেন, তিনি সে বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দিবেন। এরপর জনগণকে আমরা যুক্ত করব। জনগণকে যুক্ত করেই আমরা একটা মতৈক্যে পৌঁছাব। মতৈক্য তৈরি করার ক্ষেত্রে এ দায় শুধু অন্তবর্তী সরকারে আমরা যারা আছি তাদের নয়, এ দায়িত্ব আমাদের সকলের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সেখানে ভূমিকাটা অনেক বড়।’
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘শুধুমাত্র কাগজে-কলমে সংস্কার করে দিয়ে গেলে হবে না। আমাদের এই সংস্কারটা তো চর্চা করতে হবে, যাতে মানুষ সুফল পায়। আমাদের বর্তমানে আইনি যে কাঠামো আছে, সেটাও যদি প্রতিফলিত হতো ন্যূনতম হলেও আমরা সুফল পেতাম। এখন আসলে আমরা পরিবর্তন কোথায় চাই? আমাদের কি নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়ে গেলেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে? সেটা কি সম্ভব যতক্ষণ না পর্যন্ত মনজাগতিক পরিবর্তন আসবে?’
তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ কখনো ক্ষমতায় যাই না, দায়িত্বে যাই। দায়িত্ব পালন করতেই আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সব সময় শুনি ক্ষমতাশীল দল, আমরা তো কোনোদিন বলি না দায়িত্বপ্রাপ্ত দল। এই ক্ষমতার যে প্রয়োগ, প্রয়োগের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া। এগুলো কিন্তু আসলে আমরা কখনো তেমন করি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঐক্য কোনো পথ যদি জিজ্ঞেস করেন। সংস্কারের যে প্রয়োজন আছে সেটা আমরা সকলে স্বীকার করে নিয়েছি কিন্তু কোন কোন জায়গায় সংস্কার, কে করবে সেই সংস্কারটা? সত্যিকার অর্থে চর্চা করতে গেলে আমাদের মনোজাগতিক যে পরিবর্তনগুলো লাগবে, সেগুলো কত দিনে হওয়া দরকার, কত দিনে হওয়া সম্ভব- সেই আলোচনাটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।’
‘সকলের মতামত শুনে আমাদেরকেও ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে’ জানিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমি বললাম আর হয়ে যাবে, সে রকম না। আমাদের সকলকেই সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তুলতে হবে। সে ঐক্যমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যদি আমাদেরকে কিছুটা ছাড় দিতে হয়, সে বিষয়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কারের ব্যাপারে যদি আমরা ঐকমত্য হই, তবে একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রতিপক্ষ তখনি ভাবা হবে, যখন আমরা মুখে বলি সংস্কার চাই কিন্তু অন্তরে সংস্কার চাই না। তখনই দেখা যাবে, বিভেদটা বড় হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এবার যদি সংস্কারের প্রশ্নে আমরা পিছপা হই। তবে আমি মনে করি না, দেশের রাজনৈতিক যে স্ট্যাবলিস্ট (স্থিতিশীলতা) আসা দরকার, সে স্ট্যাবলিস্টটা আসবে বলে। আমরা জনগণের ভোটে ইলেক্টেড (নির্বাচিত) সরকার না। তবে বিপ্লবের মাধ্যমে আশা একটা সরকার তার ম্যান্ডেট নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। সে জানে তার ম্যান্ডেটটা কি। এ ম্যান্ডেটে আমাদের সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।’
এই উপদেষ্টা বলেন, ‘জনগণের মতের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সংস্কারের মাধ্যমে। যদি সংস্কারের মাধ্যমে আমরা জনগণের প্রতিফলন ঘটাতে না পারি, তাহলে রাজনৈতিক যে স্থিতিশীলতা এচিভ (অর্জন) করা কঠিন হবে। মানুষের প্রত্যাশা সাথে যদি আমাদের গ্যাপ (দূরত্ব) থেকে যায়, তাহলে বারবারই আমরা রাজনৈতিক এক ধরনের অস্বস্তি ও জটিলতার মধ্যে পড়ব।’
তিনি বলেন, ‘ঐক্যের পথটা সরল না, ঐক্যের পথটা আঁকাবাঁকাই হবে, কঠিন হবে কিন্তু আমাদেরকে বদ্ধপরিকর হতে হবে, সেখানে জনগণের আশার প্রতিফলন যেন আমরা দেখাতে পারি।’