ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রেণ রাখার আন্তর্জাতিক দাবি অমান্য করেছে এবং তার ইউরেনিয়ামের পরিশোধন করে অস্ত্র মানের কাছাকাছি নিয়ে গেছে বলে জাতিসঙ্ঘের নজরদারি সংস্থার গোপন প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস দেখেছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ইরানের কাছে ১৮২ দশমিক ৩ কিলোগ্রাম (৪০১ দশমিক ৯ পাউন্ড) ইউরেনিয়ামের ৬০ শতাংশ পরিশোধন করা হয় যা আগস্টে দেয়া গত প্রতিবেদনের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬ কিলোগ্রাম (৩৮ দশমিক ৮ পাউন্ড) বেশি।
৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়ামের পরিশোধন, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ পরিশোধনের কাছাকাছি।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ত্রৈ-মাসিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ইরানের মোট পরিশোধিত ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ৬,৬০৪.৪ কিলোগ্রাম (১৪,৫৬০ পাউন্ড)। এটি আগস্টের তূলনায় ৮৫২.৬ কিলোগ্রাম (১,৮৭৯.৬ পাউন্ড) বেশি। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রায় ৪২ কিলোগ্রাম (৯২.৫ পাউন্ড) ইউরেনিয়ামের ৬০ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম তাত্বিকভাবে একটি আণবিক বোমা তৈরি করতে পারে, যদি তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন করা হয়।
এই প্রতিবেদনটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পাওয়া গেল যখন ইরান সমর্থিত হামাস শাসিত গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা যুদ্ধের পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরাইল ও ইরান পরস্পরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে।
এই জটিলতার মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূনর্নিবাচনে এই প্রশ্ন উঠে এসেছে যে ইরানের সাথে সমাগত প্রশাসন আদৌ সম্পৃক্ত হবে কি না, হলে কিভাবে হবে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে ‘সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টির’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইরানের সাথে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে আমেরিকাকে সরিয়ে আনেন, সেখানকার অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং দেশটির শীর্ষ জেনারেলকে হত্যার নির্দেশ দেন।
পাশ্চাত্য কুটনীতিকরা ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বিবেচনা করছেন
গত সপ্তাহে তেহরানে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসির তেহরান সফরের সময়ে ইরান আশ্বাস দেয় যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত ইউরেনিয়ামের মওজুদ সে আর বাড়াবে না।
বৈঠকগুলোর সময়ে আইএইএ বলেন, ‘ইউ-২৩৫-এর ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত ইউরেনিয়ামের মওজুদ আর বৃদ্ধি না করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এটি প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে এই সংস্থাটি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত যাচাই প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে।’
ভিয়েনায় আইএইএয়ের বোর্ড অফ গভর্ণরস’এর নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকের আগে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হলো।
স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনায় নাম প্রকাশ না করেই একজন ঊর্ধ্বতন পাশ্চাত্য কূটনীতিক এপিকে নিশ্চিত করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এ সপ্তাহের আইএইএয়ের বোর্ড অফ গভর্ণরস’এর বৈঠকে ইরানের অসহযোগিতার সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করবে যার ফলে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের আগেই ইরানের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে সংবাদদাতাদের বলেন, ‘আইএইএয়ের বোর্ড অফ গভর্ণরস-এর বৈঠকের আগে আমরা আমাদের ই-থ্রি (ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য)-এর সাথে গভীর সমন্বয় সাধন করে চলেছি এবং ইরানকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো বিশ্বাসযোগ্য অসামরিক উদ্দেশ্য ছাড়াই ইরানি শাসক উচ্চ পর্যায়ে পরিশোধিত ইউরেনিয়ামের ক্রমবর্ধমানভাবে বিশাল মওজুদ করে যাচ্ছে এবং তারা অব্যাহতভাবে আইএইএয়ের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করছে না।’
স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক বলেন, ‘এমনটা হতে পারে যে আইএইএয়ের প্রধানের সফরের সময়ে ইরানের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো আর নাও থাকতে পারে যদি এই প্রস্তাব পাশ করা হয়। অতীতে ইরান আইএইএয়ের বোর্ড অফ গভর্ণরস-এর নেয়া প্রস্তাবগুলোর প্রতিক্রয়ায় তার পারমণবিক কর্মসূচি আরো বাড়িয়েছে।
ইরান বারবার বলে এসেছে যে তার পরমাণু কর্মসূচি কেবল মাত্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য কিন্তু গ্রসি আগেই সতর্ক করেছেন যে ইরান ইচ্ছে করলে অনেকগুলো পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে কারণ তার কাছে অস্ত্র নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত পরিশোধিত ইউরেনিয়াম আছে। তিনি এটা ম্বীকার করেন যে জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটি এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে ইরানের কোনো সেন্ট্রিফিউজই গোপনে পরিশোধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে না।
নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘে ইরানের মিশন মন্তব্যের জন্য তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া দেয়নি।
সম্পর্ক উন্নয়নে নেই কোনো অগ্রগতি
আইএইএ আরো জানিয়েছে যে গ্রসির তরফ থেকে আবেদন জানানোর পরও ইরান সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। গত সপ্তাহে গ্রসি ইরানের আণবিক শক্তি সংগঠনের মোহাম্মদ এসলামি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগাচি এবং ইরানের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সাথে আলোচনা করেন।
তবে মঙ্গলবারের এই গোপন প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ১৪ নভেম্বর ইরানে গ্রসির সফরের সময়ে, ‘ইরান এই সংস্থার এই উদ্বেগে সাড়া দিতে সম্মত হয় যে সংস্থার অনেকগুলো অভিজ্ঞ পরিদর্শককে ইরান প্রত্যাহার করে নেয়, শুধু চারজন অভিজ্ঞ অতিরিক্ত পরিদর্শককে গ্রহণ করতে বিবেচনায় নেয়।’
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরান ভিয়েনা ভিত্তিক এই সংস্থার সব চেয়ে অভিজ্ঞ পরিদর্শকদের নিষিদ্ধ করে।
এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে ২০২২ সালে সরিয়ে ফেলা ক্যামেরাসহ নজরদারি যন্ত্রপাতি সেখানে আবার লাগানোর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তখন থেকে ২০২৩ সালের মে মাসে ইসফাহানের একটি সেন্ট্রিফিউজ কর্মশালায় আইএইএয়ের বসানো ক্যামেরারগুলোর মাধ্যমে কেবল রেকর্ড করা উপাত্তগলি পাওয়া যাচ্ছে, যদিও ইরান আইএইএ-কে এই উপাত্তের নাগাল পেতে দেয়নি।
গত সপ্তাহে এসলামি সতর্ক করে দেন যে আইএইএয়ের আসন্ন বোর্ড সভায় ইরানকে চ্যালেঞ্জ করা হলে, ইরান পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে।
গ্রসি স্বীকার করেন যে কোন কোন দেশ ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
ইরান যাতে আণবিক অস্ত্র নির্মাণ না করতে পারে সেই প্রচেষ্টায় বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ২০১৫ সালে তেহরানের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যার আওতায় ইরান ইউরেনিয়াম পরিশোধনের মাত্রা সেই পর্যন্ত সীমিত রাখতে সম্মত হয় যা পরমানু শক্তির জন্য প্রয়োজন। এর বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
২০১৫ সালের এই মূল পারমাণবিক চুক্তি অনুযায়ী, ইরানকে কেবল মাত্র ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ইউরেনিয়াম পরিশোধনের অনুমোদন দেয়া হয় এবং ইরান কেবল মাত্র ৩০০ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম মওজুদ রাখতে পারবে।
এক বছর পর ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর, ইরান তার কর্মসূচি সম্পর্কে দেয়া ওই চুক্তির সব সীমা ক্রমশই পরিহার করে এবং ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতা পর্যন্ত ইউরেনিয়াম পরিশোধন শুরু করে।
সূত্র : ভিওএ