কয়েক দিনের ব্যবধানেই বদলে গেছে ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চিত্র। চটকদার ছবি, হাস্যরসাত্মক মিম কিংবা রাজনৈতিক ব্যঙ্গ ছাপিয়ে পোস্টগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে মহামারি নিয়ে তীব্র উৎকন্ঠা। টুইটার এবং ইন্সটাগ্রামের পোস্টে জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন নেটিজেনরা। করোনা মহামারির সাম্প্রতিক ঢেউয়ের ধাক্কায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে। এমনকি শবদেহের অন্তিম বন্দোবস্ত করতেও হিমশিম খেয়ে চলেছে ভারত।
ইন্সটাগ্রাম ব্যবহাকারী দিল্লীর ভারাত পাটেকাটের ফিডে দেখা গেল আকুতিপূর্ণ একটি পোস্ট- “দয়া করে আমাকে সাহায্য করো মুম্বাই! নিউমোনিয়ার সংক্রমণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত। আইসিইউ শয্যা প্রয়োজন।” অপর এক পোস্টে লেখা- “দিল্লীর ম্যাক্স হাসপাতালে কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্লাজমা প্রয়োজন।” অন্য একটি পোস্টে লেখা- “জরুরিভাবে টোসিলিজুমাব ইনজেকশন প্রয়োজন। মুম্বাইয়ের আশেপাশে ইনজেকশনটি কোথায় পাওয়া যাবে তা জানলে দয়া করে সরাসরি ম্যাসেজ দিন।”
প্রতিবার নিউজ ফিড রিফ্রেশ করার করার পরই চারদিক থেকে নতুন নতুন অনুরোধ সংবলিত পোস্ট এসে হাজির হয় বলে জানান পাটেকাট। ২০ বছর বয়সী আইনের শিক্ষার্থী পাটেকাট বলেন, “আমার মাথায় আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভার ধরছে না। যা পড়ছি, সেগুলো নিতে পারছি না। নিজেকে অসাড় মনে হচ্ছে।”
টুইটার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রামসহ প্রতিটি যোগাযোগ মাধ্যম উদ্বেগপূর্ণ বার্তায় ছেয়ে গেছে। হাসপাতালের শয্যা থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, সিটি স্ক্যান, ঘরে থেকে কোভিড টেস্ট এমনকি কোয়ারেন্টাইনে বয়োঃবৃদ্ধদের খাবার সরবরাহের জন্যও পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবরা আকুতি-মিনতি জানিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছেন।
মরিয়া এই আর্তনাদ, সাহায্যের হাহাকার – এ সবকিছুই বলে দিচ্ছে ১৩০ কোটি মানুষের দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি। বিশ্বে দ্রুত সংক্রমণের শীর্ষে থাকা ভারত এখন এক ভয়াবহ দুঃসময় পার করে চলেছে। সেই সাথে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বার্তাগুলো ওষুধপত্র, আইসিইউ শয্যা এবং অক্সিজেনের বিদ্যমান সংকটের মাঝে মানুষের আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলার চিত্রও উন্মোচিত করেছে।
বৃহস্পতিবার ভারতে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড সংখ্যক দুই হাজার ১০৪ জন মৃত্যুবরণ করে। অন্যদিকে, নতুন করে শনাক্ত হয় আরও তিন লাখ ১৪ হাজার ৮৩৫ জন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে বিশ্বে দৈনিক সর্বোচ্চ শনাক্ত সংখ্যা ভারতের।
মোট সংক্রমণ সংখ্যার দিক থেকে ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির অবস্থান। নতুন এই ঢেউয়ের কারণে ভারতের আর্থিক এবং রাজনৈতিক রাজধানী মুম্বাই এবং দিল্লীতে চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ২০ এপ্রিল থেকে দিল্লীতে ছয় দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। সংক্রমণ রোধে বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) থেকে মুম্বাই-মহারাষ্ট্রেও শুরু হচ্ছে লকডাউন।
ইন্সটাগ্রামের একটি পোস্ট পাটেকাটকে গভীরভাবে ধাক্কা দিয়েছে। লক্ষ্ণৌর এক হাসপাতালে মায়ের শয্যার পাশে কাটানো এক নারী হাসপাতালের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জান্না, নতুন আসা অক্সিজেন সিলিন্ডার দখলের জন্য হাসপাতালের মানুষ ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে, নয়া দিল্লীর এক হাসপাতাল চেইন জরুরি এই গ্যাস সিলিন্ডারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আদালতের দারস্থ হয়েছে।
সাংবাদিক বারখা দত্ত গুজরাট প্রদেশের সুরাটে এক শ্মশান ঘাটের ছবি পোস্টের মাধ্যমে, দেশে মৃতদেহের সৎকারের জন্য স্থান সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন।
তবে, দেশব্যাপী হাহাকারের বিষয়টি ভারতের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রঞ্জন পাইয়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফিডে আরও অধিকমাত্রায় প্রতীয়মান। রঞ্জন দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল চেইন মানিপাল হেলদ এন্টারপ্রাইসেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার ইনবক্স ভারতের হাজার হাজার মানুষের অনুরোধ বার্তায় ভেসে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরিচিত মানুষজন তাকে আইসিইউ, শয্যা, অক্সিজেন সরবরাহ এবং কোভিডের ওষুধের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। কিন্তু, রঞ্জন পাইয়ের ২৭টি হাসপাতালের সাত হাজার শয্যাই এখন পরিপূর্ণ।
“আমরা অপ্রস্তুত ছিলাম। কোনো দেশেরই এত দ্রুত এবং গুরুতর ঢেউ সামলানোর সক্ষমতা নেই।”
ফেব্রুয়ারি মাসে মানিপাল হাসপাতালের মাত্র চার শতাংশ শয্যায় করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে তা ৬৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। বাকি শয্যাগুলোও ইতোমধ্যে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং অন্যান্য জরুরিভাবে আক্রান্ত রোগীদের দিয়ে পরিপূর্ণ। হাসপাতালের ডাক্তার এবং প্রশাসন সীমার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে এখন হিমশিম খাচ্ছে বলে জানান তিনি।
নতুন ঢেউয়ের কারণে পুনরুদ্ধারের পথে থাকা ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি পুনরায় ধাক্কা খেতে চলেছে। এসঅ্যান্ডপি বিএসই সেনসেক্স সূচকে ১৫ ফেব্রুয়ারির রেকর্ডের পর শেয়ারবাজারে প্রায় নয় শতাংশ পর্যন্ত ধস নেমেছে। অন্যদিকে, ভারতীয় মুদ্রার মানও রেকর্ড হারে কমতে শুরু করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরতে থাকা একাধিক রোগীর এক শয্যা ব্যবহার, মুম্বাইয়ের হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষারত সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স এবং অক্সিজেনের অপেক্ষারত মুমূর্ষু রোগীদের ছবিগুলো দেশটির থমকে যাওয়া জরাজীর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে। সরকারি হেল্পলাইনও অকার্যকর। হাজার হাজার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডিসিভির এবং প্লাজমা ডোনারের সন্ধান চাওয়া হচ্ছে।
তবে, এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিরও আছে এক উজ্জ্বল দিক। ছাত্র থেকে শুরু করে প্রযুক্তিবিদ, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এমনকি সনু সুদের মতো বলিউড অভিনেতারাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। খাদ্য সরবরাহ, রেমডিসিভির বা হাসপাতাল শয্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তারা প্রচার করছেন। জরুরি সাহায্যের আর্তনাদগুলোকে তারা বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত স্বেচ্ছাসেবকরা রোগীদের দরজায় খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তারাই আজকের দিনের প্রকৃত নায়ক বলে মন্তব্য করেন চেন্নাইয়ের প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল বিটের প্রতিষ্ঠাতা বিকাশ চাওলা।
“কোনো ঘটনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক মানুষের এগিয়ে আসা,” বলেন চাওলা।
সূত্র: ব্লুমবার্গ