বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। সময়টা দেশের জন্যে, জাতির জন্যে অত্যন্ত ক্রান্তিকাল। এই সময়ে সাহসের সঙ্গে, ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে গণতন্ত্রকে ছিনিয়ে আনতে হবে।
মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন।
সবাইকে বাংলা নববর্ষ ও মাহে রমজানের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ আজ আমাদের সমগ্র জাতীয় জীবনকে এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিদিন প্রিয়জন হারানোর সংবাদ আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবনকে স্থবির করে তুলেছে। করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ইতোমধ্যে আমাদের দলের ও দেশের অনেক প্রথিতযশা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব করোনার ছোবলে সবার মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এধরনের অভিজ্ঞ ও বরেণ্য মানুষের চলে যাওয়া সমগ্র জাতিকে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন করে ফেলেছে। শুরুতেই গত ১ বছরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং এই মুহূর্তে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সকলের রোগমুক্তির জন্য দেশবাসীর দোয়া চাই। মহান আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে মোনাজাত করি, তিনি যেন প্রত্যেককে এ মৃত্যুছোবলকারী করোনা থেকে রক্ষা করেন।
তিনি বলেন, আসন্ন রমজান এবং বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে তথাকথিত লকডাউনের প্রাক্কালে সরকারের ব্যর্থতার কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। এ সরকার প্রথম থেকেই জনজীবনকে তাচ্ছিল্য করে আসছে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর মিথ্যা ও প্রতারণামূলক শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা কিভাবে চালসহ প্রত্যেকটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে তা আপনারা ভুক্তভোগীরা সবাই অবগত আছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊধ্বগতির সাথে সাধারণ মানুষ পাল্লা দিতে পারছে না। বিদ্যুতের দাম, বাসা ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ এতই Hard-hit যে, নিম্ন আয়ের শ্রেণি যারা একসময় খেয়ে-পরে ভালই ছিল, তারা আজ প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে বাজার সিন্ডিকেটগুলো সবই আওয়ামী লীগের তথা সরকারের মদদপুষ্ট লোকজন দিয়ে পরিচালিত বিধায় এরাই যোগসাজশ করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগে মানুষ টিসিবির ট্রাকে কম মূল্যে জিনিসপত্র পাবে বলে আশায় থাকত। কিন্তু এখন টিসিবিও নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে আগে যারা কষ্ট হলেও দোকান থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস খরিদ করত, তাদের অনেককেই এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়। জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এই শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মান দ্রুত অবনত হয়ে তারা declassed হয়ে নিম্নতর পর্যায়ে নেমে গেছে। আর যারা আগে থেকেই টিসিবির ওএমএসের পণ্য কিনত তারাও আর কিনতে পারছে না মূল্যবৃদ্ধির কারণে। মানুষের জীবনে হাহাকার আর ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্তের খাবারের সংস্থান কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফখরুল বলেন, এক জরিপে দেখা গেছে যে, ৩৪.৮ শতাংশ পরিবারেরর কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছে। ২০২০ সনের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড়ে পারিবারিক উপার্জন কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। মধ্য ও নিম্ন বিত্তের হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নয়ত বেতন পাচ্ছে না, নয়ত বেতন কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। জীবনযুদ্ধে টিকতে না পেরে শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছেন অনেকে। এর সঙ্গে অনেক স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা এমন সময় কথা বলছি, যখন করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বর্তমান ভোটারবিহীন গণবিচ্ছিন্ন সরকার লকডাউনের নামে আবার একটি অকার্যকর শাটডাউন জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে দেশের কোটি কোটি ‘দিন আনে দিন খায়’ এ শ্রেণীর শ্রমজীবী ও Informal Sector এ কর্মরতদের জীবনে ভয়ংকর এক দুঃসময় নেমে এসেছে। লক-ডাউনে দিন আনে দিন খায়- এ শ্রেণির দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে সরকার পুনরায় অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর আগে এ শ্রেণির মানুষের জন্য প্রদত্ত রিলিফ ও টেলিফোনে প্রদত্ত সামান্য নগদ টাকাও কিভাবে লুট হয়ে গেছে তা আপনারা সবাই জানেন। এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের বর্তমান লাগামহীন ঊধ্বর্গতি পরিস্থিতি কোন শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে ঠেকাবে তা কল্পনাও করা যায় না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। সেই হিসাবে করোনাকাল চলছে এক বছরেরও বেশি। এ সময়ে একদিকে মানুষের আয় কমেছে, অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে অনেক গুণ। এমনিতেই করোনার কারণে বেকার হয়েছে বহু মানুষ। আর চাকরি যাঁদের আছেও, তাঁদের আয়–রোজগার কমেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে দাড়িয়েছে। এর মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসের আগে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থা জনজীবনে ব্যাপকভাবে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রাত্রিরিক্তভাবে বেড়েছে।
দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে। অথচ বাংলাদেশে এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)র থেকেও দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। যা বাজারের মুল্যবৃদ্ধিতে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। এবারে যেমন টিসিবি পবিত্র রমজান মাসের আগে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে বাড়ালো ১০ টাকা। সংস্থাটি প্রতি লিটার তেল ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এ নিয়ে টিসিবি জানুয়ারির পর দুই দফায় লিটারে ২০ টাকা বাড়ল সয়াবিন তেলের দাম। শুধু সয়াবিন তেল নয়, টিসিবি চিনির দামও কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। এখন সংস্থাটি প্রতি কেজি চিনি ও মসুর ডাল ৫৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৭ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং পাইজাম চালের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া আটার দাম ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ ও ময়দার দাম বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। খুচরা দোকান থেকে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাগছে। বাছাই করা পেঁয়াজ ৫৫-৬০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, রমজানকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে, চিনি, আটা, গুঁড়া দুধ, তেল, পিয়াজ, আদা, রসুন, বেগুন, খেজুর, শসা ও লেবু সবকিছুর দাম ইতোমধ্যেই অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতি বোঝাতেই একটা উদাহরণই যথেষ্ট। বাজারে ছোট ৪টা লেবুর দাম ৫০ থেকে ৭০ টাকা। করোনায় গরীবের ভিটামিন সি সরবরাহের প্রধান উৎস লেবুও এখন সাধারণের নাগালের বাইরে। রমজানে খেজুর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। অথচ খেজুরের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মহামারী করোনাকালীন সময়েও যে সরকারের সুবিধাভোগী, লোভী, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সাধারণ মানুষের পকেট কেটে লুটপাট বিন্দুমাত্র কমেনি।
বাংলাদেশ এক অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাপনার কবলে পড়েছে যে সময় থেকে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলছে। যা আজও অব্যাহত আছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটকারীদের এক নতুন কারসাজির বিষয়ে বলতে চাই। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে বছর ১০/১২ আগে রমজান এলে পণ্যের দাম বাড়তো, আর এখন রমজান মাস আসার ১-২ মাস আগেই কৌশলে দাম বাড়ানো হয়। আবার রোজার সপ্তাহ খানেক আগে একটু কমানো হয়। পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ আর সপ্তাহ খানেক আগে কমানো হয় ৫ শতাংশ। যাতে করে এই চক্র বলতে পারে, পণ্যের দাম তা কমেছে। এই ধরনের অপকৌশল ভোক্তাদের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণার শামিল। সবচেয়ে,ভয়ংকর বিষয় মুল্যবৃদ্ধির এই প্রতারক ও দুর্নীতিবাজ চক্রের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সরকারের চালিকাশক্তিরাই। যারা, আজকে মহামারী করোনার টীকা নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ঘৃণ্যতম মনোপলি ব্যবসা করছে, তারাই আধুনিক কর্পোরেট বাণিজ্যে বন্ধুত্বের মিথ্যা আষাড়ে গল্প শুনিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে সমস্ত জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান ভোটারবিহীন অবৈধ সরকারের সময় যে ধরনের লাগামহীন দুর্নীতি চলছে মুলত তারই ধারাবাহিকতায় লুটেরা সরকারের সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী চক্রের হাতে দৈনন্দিন ভোগ্যপন্যের বাজার ব্যবস্থাপনাও জিম্মি হয়ে আছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার দূরীকরণের কোনো বিকল্প নাই। এ সরকারের জনগণের কাছে কোন দায়বদ্ধতা নেই বিধায় তারা জনগণের কল্যাণের তোয়াক্কা না করে নিদারুণভাবে নিষ্ঠুর ও নির্দয় হয়ে পড়েছে। এমতাবস্তায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপির নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক ও কল্যাণময় সরকার প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক আন্দোলনে অংশ নিতে হবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।