spot_img

করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল চীন টিকায় নিয়েছে কৌশলী পথ

অবশ্যই পরুন

ইতোমধ্যে যারা করোনার টিকা নিয়ে ফেলেছেন বেইজিংয়ে তারা একটি আইসক্রিম কিনলে আরেকটি ফ্রি পাচ্ছেন। গানসু প্রদেশের সরকারি এক কর্মকর্তা করোনার টিকার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে ২০ লাইনের একটি কবিতা লিখেছেন। ওয়াংচেং নামে একটি শহরে অভিভাবকদের সতর্ক করা হচ্ছে এই বলে যে, তারা যদি করোনার টিকা নিতে রাজি না হন তবে তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ,ভবিষ্যতে চাকরির সুযোগ ও হাউজিং সুবিধা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

চলতি বছরের জুনের মধ্যে ৫৬ কোটি বা ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায় চীন। এর জন্য দেশটি বেশ কিছু কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। এসব কৌশলের কোনোটি আশা জাগানিয়া আবার কোনটি ভীতিপ্রদর্শনমূলক। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে কতটা শক্ত হওয়া যায় তার একটা চিত্র ইতোমধ্যে চীন দেখিয়েছে।

তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে দেশটিতে। ইতোমধ্যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে চীন। আর এর জন্য দেশটির বহু নাগরিক টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না। আবার টিকাকেন্দ্রিক চীনের বিভিন্ন স্ক্যান্ডাল নিয়েও আতংকিত অনেকে। আবার করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে দেশটিতে স্বচ্ছতার যে ঘাটতি আছে সেটির জন্যও এ টিকা অনেকের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। এসবের পরও দেশটির বিপুল জনসংখ্যা তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েই গেছে।

বিরাট এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনা সরকার তাদের পুরোনো হাতিয়ারই বেছে নিয়েছে; যার মূল শক্তি হচ্ছে বলপ্রয়োগ ও দেশটির বিস্তৃত আমলাতন্ত্র। এ মন্ত্রেই মূলত চীন দেশটিতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। আর এবার টিকা প্রদানের ক্ষেত্রেও তাই একই পথে হাঁটতে চায় কর্তৃপক্ষ।

ইতোমধ্যে এ পদ্ধতিতে বড় পরিসরে এগিয়েছে চীন। গত মাসে যেখানে দিনে ১০ লাখের মতো মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছিল, গত সপ্তাহে সেখানে দিনে গড়ে ৪০ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুনের মধ্যে ৪০ শতাংশ চীনাকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তারা শিগগিরই দিনে ১ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া শুরু করতে পারবেন বলে আশাবাদী।

বেইজিংয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অ্যানি চেন বলেছেন, বলা হচ্ছে টিকা নেওয়ার বিষয়টি ঐচ্ছিক, কিন্তু কেউ যদি টিকা না নেন তবে তাকে ক্রমাগত কল করে যাওয়া হচ্ছে। অ্যানি নিজেও দু’বার এমন কল পেয়েছেন।

টিকার সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগের কারণে অ্যানি টিকার নিবন্ধন করেছিলেন না। কিন্তু তাকে যখন একজন কাউন্সেলর ফোন করে সতর্ক করলেন যে, তিনি যদি টিকা  না নেন তিনি হয়তো পাবলিক প্লেসগুলোতে চলাচলের অধিকার হারাবেন তখন তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও ভাবনা শুরু করেন। এ ছাড়া ওই কাউন্সেলরের জন্যও তার খারাপ লাগছিল। অ্যানি বলছেন, ওই কাউন্সেলরের কাজটা মোটেও সহজ না। কণ্ঠ শুনে তাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

টিকা নিয়ে শুরু থেকেই মানুষের মনে একটা আতংক আছে। ফেব্রুয়ারিতে চালানো একটি জরিপে দেখা যায় চীনের পূর্বাঞ্চলের ঝিজিয়াং প্রদেশের অর্ধেক স্বাস্থ্যকর্মীও টিকা নিতে আগ্রহী ছিলেন না। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েই ভয় ছিল তাদের। আর মার্চের মাঝামাঝি এসে ১০০ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে মাত্র সাড়ে ৬ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

বড় উদ্যমে চীনে টিকাপ্রদান কার্যক্রম চললেও বেশ কিছু দেশ থেকে এখনও অনেক পেছনে রয়ে গেছে চীন। দেশেই উদ্ভাবিত পাঁচটি টিকা ব্যবহারের অনুমোদন চীনে থাকলেও প্রতি ১০০ জন নাগরিকের মধ্যে মাত্র ১০ জনকে টিকা দিতে পেরেছে দেশটি। ১০০ জনে ব্রিটেন ৫৬ জনকে আর যুক্তরাষ্ট্র ৫০ জনকে টিকা দিয়েছে।

চীনের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চীনের যে সফলতা ছিল তা টিকাপ্রদানের ধীরগতির কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে।

চীনা একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশটির একজন শীর্ষ শ্বাসযন্ত্রের রোগ বিশেষজ্ঞ ঝং নানশান বলছেন, চীন খুব জটিল একটা সময়ে আছে। অন্যান্য দেশ যখন টিকাপ্রদান কার্যক্রম বেশ ভালোভাবে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন সংক্রমণ থেকে মুক্তির পথে পিছিয়ে থাকছে চীন। এটা খুব বিপদের কথা।

সোমবার টিকাকেন্দ্রিক বিভিন্ন অফারের ছড়াছড়ি দেখা গেল বেইজিংয়ের ওয়াংফুজিং শপিং ডিস্ট্রিক্টে। একটি দোকানে দেখা গেল যারা টিকা নিয়েছেন তাদের বিনামূল্যে একটি কিট দেওয়া হচ্ছে, টিকা নেওয়াদের একটি চায়ের দোকানে দেওয়া হচ্ছিল ১০ শতাংশ ছাড়। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ফটো স্টুডিও টিকা নেওয়া যুগলের বিয়ের ছবির জন্য ছাড় থাকার কথা জানিয়েছে বিজ্ঞাপনে।

অন্তত একটি টিকাদান কেন্দ্রে এ ছাড়ের কৌশল কাজ করছিল। সেখানে টিকা নিয়ে একটি আইসক্রিম কিনলে একটি আইসক্রিম ফ্রি দেওয়া হচ্ছিল। ম্যাকডোনাল্ড থেকে দেওয়া হচ্ছিল এই আইসক্রিম। ওয়াং জুয়ান নামে সেখানকার একজন কর্মী টিকা নিলে আইসক্রিম ফ্রি দেওয়ার এই বিজ্ঞাপন কতটা কার্যকর হয়েছে, তার একটা চিত্র তুলে ধরলেন এভাবে- একজন লোক সোজা এসে কেন্দ্রে চলে গেলেন টিকা নিতে, আর টিকা নিয়ে বের হয়েই তিনি চলে এলেন আমাদের কাছে আইসক্রিম নিতে।

একটি কোম্পানি তাদের কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া নোটিশে লিখেছে, ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী, যাদের শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা নেই তাদের অবশ্যই এপ্রিলের মধ্যে টিকা নিতে হবে, নতু্বা তাদের দায় নিতে হবে। যদিও এ নোটিশের পরবর্তী কোনো ব্যাখ্যা কোম্পানির তরফ থেকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া হাইকোও শহরের একটি সরকারি বুলেটিনে সতর্ক করা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে টিকা নেওয়া কর্মীর হার ৮৫ শতাংশের কম তাদের সতর্ক করা হবে ও সংশোধনের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে সাসপেন্ড করা হতে পারে।

রুইলি নামে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর প্রথম শহর হিসেবে গত সপ্তাহে টিকা নেওয়ার যোগ্য সবার জন্য টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করে। শহরটির একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের লক্ষ্য ছিল ৫ দিনে টিকাদান কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা রেখে শহরটির পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রদান করা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অভিযোগ করছেন টিকা নিতে তাদের যে চাপ দেওয়া হচ্ছে সেটা তাদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বেছে নেওয়ার অধিকার হরণ করছে।  তবে সাংহাই সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের টিকা বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ইমিউনোলজিস্ট তাও লিনা মনে করছেন, জনস্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে এখন বিভিন্ন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়াটাও ন্যায়সঙ্গত।

ড. তাও বলছেন, এই সময়ে এ বিষয়ে পছন্দের স্বাধীনতার ওপর জোর দেওয়াটা খুব ভালো কোনো চিন্তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকান, তারা চেয়েছিল তারা মাস্ক পরবে না। সেটাও এক ধরনের স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু তারপর কী হলো?

চীন বাদে অন্যান্য অনেক দেশেই সরকার ও বিভিন্ন কোম্পানির তরফ থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যেগুলো অনেকের কাছে জবরদস্তিমূলক বলে মনে হচ্ছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে একটি ডিক্রি জারি করেছেন, যেখানে দেশটির স্বাস্থ্যকর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে করোনার টিকা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। টিকা নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় নিউ ইয়র্কে একটি হোটেলের একজন কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেক দেশ ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালুর চিন্তাও করছে।

তবে এসবের মধ্যেই চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছে যে, স্থানীয় কিছু কর্মকর্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অতিউৎসাহী হয়ে কাজ করে ফেলছেন।

সিনহুয়ায় প্রকাশিত একটি কলামেও  টিকা নিয়ে এই সবার জন্য এক নীতির সহজ ও অপরিপক্ব পন্থার নিন্দা করা হয়েছে। এটি মানুষের মধ্যে টিকার বিরোধিতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, টিকা নিয়ে নেতিবাচক এই সব কর্মকাণ্ডের উৎপত্তি ছোট কিছু অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠানে, যারা টিকা দেওয়া নিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

টিকা না নিলে যেসব বিধিনিষেধের মুখে পড়ার কথা বলা হচ্ছে তার কতটা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হাইকোউ শহরে যারা টিকা নেবেন না, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তবে সেখানকার একজন কমিউনিটি কর্মী বলছেন, তিনি কেবল কিছু প্রতিষ্ঠানে লাল পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছেন। এসব  পোস্টারে লেখা রয়েছে- এ প্রতিষ্ঠানটি টিকার মানদণ্ড বজায়ে ব্যর্থ। কিন্তু কাউকে জরিমানা করা হয়নি। কাউকে টিকা নেওয়ার জন্য তিনি জোর করতে পারনে না বলেও জানালেন এই কর্মী। আসল কথাটা হলো- উপর থেকে আদেশ আছে।

তবে দেশটির বহু নাগরিক টিকার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে আসছেন। লু জিয়ানিয়ুন নামে একজন বললেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানে বহু শিশুকে ত্রুটিপূর্ণ টিকা দেওয়া হয়েছে। আমি এই টিকা উৎপাদনকারীদের বিশ্বাস করি না।

গর্ভবতী নারীদের জন্য করোনার টিকা কতটা নিরাপদ তা নিয়েও স্থানীয় কর্মকর্তরা সাংঘর্ষিক  নির্দেশনা দিয়েছে। সন্তান নিতে আগ্রহী এমন নারীদের কেউ কেউ আশ্বাস দিয়েছেন টিকা নিরাপদ, আবার কেউ কেউ তাদের সন্তান নিতে আরও সময় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

ড. তাও মনে করেন, করোনার টিকার বিষয়ে মানুষে আস্থা অর্জনে যথেষ্ট কাজ করা হয়নি। জনসম্মুখে টিকা নিয়েছেন এমন মানুষদের মধ্যে তিনি কেবল ড. ঝাং ওয়েনহংয়ের নাম বলতে পারলেন, যাকে চীনের ড. অ্যান্থনি ফাউসে বলে অভিহিত করা হয়। তবে এই একটি ঘটনায় চীনে ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোর তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডেটা উন্মুক্ত করার বিষয়ে খুব একটা কার্যকরী হয়নি।

তিনি আরও বলেন, টিকার বিষয়ে উৎসাহ বাড়াতে হলে দেশের নেতা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কমিউনিস্ট পার্টি মেম্বারদের টিকা নেওয়ার ভিডিও প্রচার করতে হবে।

সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস।

সর্বশেষ সংবাদ

সশস্ত্রবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাড়লো আরও ৬০ দিন

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও এর ওপরের সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার মেয়াদ আরো দুই মাস (৬০...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ