আলোকিত সোনারগাঁও ডেস্ক : আখিরাতের ভবিষ্যত জীবনে বিশ্বাসী মুমিনের কাছে তো দুনিয়ার জীবনের পুরোটা সময়ই পরীক্ষার কাল। মহান আল্লাহ বলেন, তিনি সেই সত্তা যিনি মরণ ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করে দেখবার জন্য- তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম; আর তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল (আলকুরআন ৬৭: ২)।
তবে এসবের মধ্যেও রমাযান মাসটা তার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সে চায়, মহান আল্লাহ, যিনি বিচার দিবসের মালিক, তাঁর কাছে প্রিয়ভাজন ও সম্মানিত হতে। আর সে জানে, আল্লাহর কাছে সম্মানের মাপকাঠি তাকওয়া আর তাকওয়া অর্জনের বিশেষ সময় রমাযান মাস।
মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার (আলকুরআন ২: ১৮৩)।
হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন রমাযান মাস প্রবেশ করে তখন জান্নাত, রহমত বা আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, তার একটাও বন্ধ করা হয় না; জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটাও খোলা হয় না; আর শয়তানগুলোকে শিকলে বেঁধে ফেলা হয়।
একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন, হে কল্যাণকামী, অগ্রসর হও, আর হে অকল্যাণ প্রত্যাশী, বিরত হও। আর সে সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে অগণিত মানুষকে ক্ষমা করা হয়, রমাযান শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই এটা চলতে থাকে (সহীহ বুখারি-১৮৯৯; সহীহ মুসলিম-১০৭৯; সুনান তিরমিযি-৬৮২; জামিউল উসুল ৯/২৫৮)।
অন্য হাদীসে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আদম সন্তানের সকল আমলের সাওয়াব দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, মহান আল্লাহ বলেন, একমাত্র সিয়াম তার ব্যতিক্রম, কেননা তা আমার জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান দেব; সে আমার জন্য খাবার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পরিত্যাগ করেছে।
রোযাদারের দুটি খুশি- একটি ইফতারের সময়, অন্যটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়। আর সিয়াম জনিত মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও প্রিয় (সহীহ বুখারি-৫৯২৭; সহীহ মুসলিম-১১৫১)।
এমন সব কারণে রমাযান যেহেতু মুমিনের কাছে সর্বাধিক প্রিয়, আকাঙ্খিত ও গুরুত্বপূর্ণ সময়, তাই রমাযানের আগের সময়গুলোও তার প্রস্তুতির কাল হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুমিনের পরিপূর্ণ ও একমাত্র আদর্শ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামও নিজের কথা ও কর্ম দ্বারা এমনটিই শিখিয়েছেন। আনাস ইবন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়, রমাযানের পর কোন সিয়াম উত্তম? তিনি বলেন, রমাযানের সম্মানার্থে শা’বানের সিয়াম (সুনান তিরমিযি-৬৬৩)।
তিনি রমাযান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় দুইমাস আগে, রজব মাস প্রবেশ করলেই, আল্লাহর কাছে দুআ করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শা’বান মাসে বরকত দাও এবং রমাযান পর্যন্ত পৌঁছে দাও’।
রমাযান সিয়ামের মাস, সিয়াম তাকওয়ার মাধ্যম আর তাকওয়ার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় মহান আল্লাহর নিকট বান্দার মর্যাদার স্তর। স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যত প্রত্যাশী সর্বোত্তম আদর্শ মুমিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাই রমাযানের আগেই শা’বান মাসে ব্যাপক সিয়াম পালনের মাধ্যমে রমাযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।
আয়িশা সিদ্দীকা রা. বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সারা বছর দীর্ঘদিন লাগাতার সিয়াম পালন করতেন, আবার দীর্ঘ বিরতি দিতেন। শুধু রমাযান মাসই পুরোপুরি সিয়াম পালন করতেন। তাঁকে শা’বান মাসেই সর্বাধিক (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখেছি।
আল্লাহর রাসূলের কাছে শা’বান ছিল সিয়াম পালনের সবচেয়ে প্রিয় মাস। ব্যাপকভাবে, কিছুদিন বাদ দিয়ে, বরং শা’বান পুরোটা মাস জুড়েই তিনি সিয়াম পালন করতেন (সহীহ বুখারি-১৯৬৯; সহীহ মুসলিম-১১৫৬; সুনান আবু দাউদ-২৪৩১; সুনান তিরমিযি-৭৩৭; সুনান নাসায়ি-২১৭৭)।
উম্মু সালামা রা. বলেন, শা’বান ও রমাযান ছাড়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আমি দুইমাস ধারাবাহিকভাবে সিয়াম পালন করতে দেখি নি; তিনি অব্যাহত সিয়াম পালনের মাধ্যমে শা’বানকে রমাযানের সাথে মিলিয়ে দিতেন (সুনান আবু দাউদ-২৩৩৬; সুনান তিরমিযি-৭৩৬; সুনান নাসায়ি-২১৭৫; সুনান ইবন মাজাহ-১৬৪৮)।
অন্য হাদীসে এসেছে, উসামা ইবন যায়দ রা. বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, শা’বনের মত এত অধিক সিয়াম পালন করতে তো আপনাকে অন্য কোনো মাসে দেখি না! তিনি বললেন, রজব ও রমাযানের মাঝের এমাসে লোকেরা গাফিল থাকে; এমাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে আমল উঠানো হয়। আমি চাই, সিয়ামরত অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক (মুসনাদ আহমাদ-২১৭৫৩; সুনান নাসায়ি-২৩৫৭)।
দুনিয়ার এ পরীক্ষা কেন্দ্রে আদর্শ ছাত্রের মতই তিনি এভাবে শা’বান মাস জুড়ে রমাযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন আর একটি একটি করে দিন গুণতেন। আয়িশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম শা’বান মাসের দিনের হিসাব যত গুরুত্ব সহকারে রাখতেন অন্য সময়ের হিসাব তত গুরুত্ব দিয়ে রাখতেন না। তারপর রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম রাখতেন; আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে ত্রিশদিন পূর্ণ করে সিয়াম রাখতেন (সুনান আবু দাউদ-২৩২৫)।
উম্মাতকেও তিনি এভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমাযানের জন্য শা’বানের চাঁদের হিসাব রাখো (সুনান তিরমিযি-৬৮৭)।
এটাই হচ্ছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রমাযানের প্রস্তুতি। আর তাঁকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে আমরা নির্দেশিত। মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ- এটা তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে (আলকুরআন ৩৩: ২১)।
তাঁর অনুসরণে আমাদের রমাযানের প্রস্তুতি তাই হওয়ার দরকার আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জন এবং ঈমান ও ইহতিসাবকে সামনে রেখে।
কিন্তু আমরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আদর্শকে অনেকটাই, বলা যায় পুরাটাই, বিস্মৃত হয়েছি। বিস্মৃত হয়েছি আমাদের আসল ভবিষ্যত আখিরাতকে। আমরা বস্তুবাদে বিশ্বাসী মানুষ। ইবাদতের প্রস্তুতি পর্যন্ত নিই বস্তুবাদী তরীকায়।
রমাযানকে সামনে রেখে আমরা সবাই আমাদের মত করে কমবেশি প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে মজুত করে রাখেন এবং রমাযানে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে রোযাদারের পকেট কাটেন।
কেউবা আবার এই পকেটকাটা টাকা দিয়ে ইফতার করিয়ে, রোযাদার খাওয়ায়ে, যাকাতের শাড়ি বিতরণ করে মহাপুণ্য অর্জন করেন। কিন্তু আমরা বুঝি না, এভাবে গরু মেরে জুতা দান করে আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়া য়ায় না। আমরা তো নির্দেশিত ছিলাম কল্যাণকর্মে সহযোগিতার। আল্লাহ বলেন, তোমরা তাকওয়া ও নেককর্মে একে অপরের সাহায্য করো (আলকুরআন ৫ : ২)।
তাই দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল, রোযাদারদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে রমাযানে দ্রব্যমূল্য কমে যাবে এবং এভাবে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় আল্লাহ সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা হবে।
আর আমরা সাধারণ রোযাদারেরাও রমাযানের প্রস্তুতি বলতে বুঝি, রমাযানে সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে, আগের থেকেই প্রয়োজন পরিমাণ পণ্য কিনে রাখি। এভাবে তাকওয়ার ইবাদতের প্রস্তুতিতেও আমরা বস্তুবাদী হয়ে উঠেছি।
আমাদের মত দুনিয়ামুখি দীনদারদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা তো বরং দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ; অথচ আখিরাত উত্তম ও চিরস্থায়ী (আলকুরআন ৮৭ : ১৬-১৭)।
রমাযানকে যথাযথভাবে কাজে লাগোতে পারলে আমাদের ভবিষ্যত হবে স্বর্ণোজ্জ্বল আর ব্যর্থ হলে জীবন ডুবে যাবে ব্যর্থতায়। তাই রমাযানের প্রস্তুতিতে তো আমাদের মন-মস্তিষ্ককে আলোড়িত করতে থাকবে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নির্ভরতা, তাঁর ক্ষমা, সন্তুষ্টি, তাকওয়া, প্রতিশ্রুত প্রতিদান ও কল্যাণ অর্জনের ভাবনা।
মহান আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত ভবিষ্যত বা আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করল তা চিন্তা করা। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত (আলকুরআন ৫৯: ১৮)।