মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান সংকটের আঁচ লেগেছে দেশটির সীমান্তেও। সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে চলা সহিংসতার মধ্যে ভারত ও থাইল্যান্ডে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন হাজার হাজার মানুষ।
নিজ দেশের সীমান্তে মানুষের ঢল নামার আশঙ্কায় সীমান্ত পথে আগতদের জন্য প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করেছে ভারত ও থাইল্যান্ড- দুটি দেশই।
গত সপ্তাহেও জাতিসংঘের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, দ্রুত এই রক্তপাত বন্ধের পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে মিয়ানমার।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে তাকালেও দেশটির সহিংস নীতিমালা দৃশ্যমান হয়।
মিয়ানমারের কারেন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার হাজার হাজার গ্রামবাসী ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে, তবে প্রাথমিকভাবে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাইল্যান্ড।
এসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ঘটনার পর থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচা বলেন, “আমরা বিপুল সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণে প্রস্তুত নই, তবে মানবাধিকারের ব্যাপারটিও আমাদের বিবেচনায় থাকবে। আমরা তাদের থাকার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি, তবে এই মুহূর্তেই শরণার্থী শিবির খোলার আলোচনায় যেতে চাই না,”
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর শরনার্থীদের আশ্রয় দানের দীর্ঘদিনের ইতিহাস উল্লেখ পূর্বক আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আশ্রয় প্রার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া অবৈধ এ মর্মে সতর্কতা জারি করেছে।
“নারী-শিশুসহ অসংখ্যা মানুষ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসছে, তাদের আশ্রয় নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সহকারি কমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস।
“মিয়ানমারের পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে দেশটির প্রতিবেশী দেশগুলোকে মানবিক দিক বিবেচনায় পালিয়ে আসা মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি,”
ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রবেশের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। রাজ্যটির রাজনীতিবিদ, স্থানীয় বাসিন্দারা এক হাজারেরও বেশি মানুষকে সাদরে গ্রহণ করেছেন।
পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন যারা নিরীহ জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ানমারের অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিকাল প্রিজনারের তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বিক্ষোভে ৪৬ জন শিশুসহ অন্তত ৫৫০ জন নাগরিক মারা গেছেন। প্রায় ৩ হাজার নাগরিককে আটক করা হয়েছে।
মিজোরামে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকরা ও রাজ্যটির স্থানীয় বাসিন্দারা একই নৃগোষ্ঠীর সদস্য, মিয়ানমারে চিন নামে এবং মিজোরামে মিজোস নামে পরিচিত তারা।
মিজো স্টুডেন্ট ইউনিয়নের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি লালবিন সাঙ্গার ভাষ্যে, “আমরা একই গোত্রভুক্ত। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মও একই,”
“আমাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। দেশ ও জাতীয়তায় ভিন্ন হলেও আমরা প্রকৃতপক্ষে আমরা আলাদা নই,”
সামরিক জান্তার সহিংসতার পরও প্রতিদিনই সড়কে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
তবে রাজ্যটির স্থানীয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি’র সঙ্গে টানাপোড়ন দেখা যাচ্ছে। আশ্রয় প্রার্থীদের অবৈধ অভিবাসী উল্লেখ করে তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তোরজোর শুরু করেছে বিজেপি। বাংলাদেশে বসবাসরত এক রোহিঙ্গা দম্পতির কিশোরী সন্তানকে জোরপূর্বক মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ইতোমধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বিজেপি।
গত মার্চে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গাকে নতুন আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশ রোধ ও ইতোমধ্যে আশ্রয় নেওয়াদের ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী এর জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সরকারি নীতিমালা পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। জোরামথাঙ্গা বলেন, “আমি অমিত শাহকে জানিয়ে দিয়েছি, মিয়ানমার থেকে যারা এসেছে তারা আমাদের ভাই-বোন। তাদের বেশিরভাগের সঙ্গেই আমাদের পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। তারা মিজোরামে আসলে তাদের খাদ্য ও আশ্রয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের,”
মিজোরামের একজন স্থানীয় কর্মকর্তা জানান, মিজোরামে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের খুব অল্প অংশের অর্থনৈতিক চাপ পড়বে সরকারের ওপর। তাদের বেশিরভাগই রাজ্যটির কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
তবে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকতে এ অবস্থা বদলে যেতে পারে। মিজোরামের সাথে মিয়ানমারের ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের আন্দোলনকারীরাও জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখছেন, সেই সাথে দেশটির পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন বজায় থাকলে গেরিলা যুদ্ধে অভিজ্ঞ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠীর অন্তত তিনটি সশস্ত্র গ্রুপ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধের নাম দেওয়া হয়েছে “বসন্ত বিপ্লব’।
বিরোধী দলও অভ্যন্তরীণ সংবিধান নিয়ে কাজ করছে যেখানে বর্তমান সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এনে ‘ফেডারেল আর্মি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
সংখ্যা ও ক্ষমতায় কম হলেও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিরোধী পক্ষ একজোট হলে এই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
ইউনাইটেড ফর ডেমোক্রেটিক মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট লাওমা চাংতের ভাষ্যে, “অবস্থাদৃষ্ট দেখে ধারণা করছি আরও অনেক মানুষ মিজোরামে আশ্রয় চাইছে।,”
“এখন পর্যন্ত বেশিরভাগই তাদের আত্মীয়ের বাসায় থাকছেন। কিন্তু এই সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে যদি স্থানীয়রা স্থান সংকুলান করতে না পারেন সে পরিস্থিতি সামলাতে আমরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রস্তুতি রাখছি,” বলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান