সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে মিয়ানমারে তীব্র গণবিক্ষোভ চলার মধ্যেই দেশটির সেনাপ্রধান মিন অ্যং হ্লেইং ঘোষণা করেছেন— সেনাবাহিনীও গণতন্ত্র চায় এবং একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করাই মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য।
দেশটিতে বর্তমানে যারা বিক্ষোভ করছেন, তারা আসলে আন্দোলনের নামে মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ক্ষতি করছেন বলেও মন্তব্য করেছেন হ্লেইং। আন্দোলনের কারণে মিয়ানমারের নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। যদিও কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে সেখানে, সে সম্পর্কিত কোনো ইঙ্গিত দেননি সেনাপ্রধান।
শনিবার মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দিবস উপলক্ষে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেলে এক ভাষণে মিন অ্যং হ্লেইং বলেন, ‘দেশের জনগণের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় সামরিক বাহিনী। অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।’
‘যারা বিক্ষোভ করছেন, তারা আসলে আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা করতে চাইছেন এবং মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে হুমকির মুখে ফেলছেন। তাদের এ ধরনের কার্যক্রমে নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না।’
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারে এ পর্যন্ত ৩২৮ মানুষকে হত্যা করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। শুক্রবারও দেশটিতে ৪ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে।
নিহতদের ৯০ শতাংশকেই গুলি করে এবং তাদের এক-চতুর্থাংশকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাসিস্টান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস (এএপিপি) ও স্থানীয় বিভিন্ন মিডিয়ার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। তবে জান্তা সরকারের এক মুখপাত্র দাবি করেছেন, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৬৪ জন বিক্ষোভকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ৯ সদস্য নিহত হয়েছেন।
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর থেকে দেশটির লাখ লাখ মানুষ সেনাশাসনের অবসানের দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছেন। গৃহবন্দি নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছেন তারা। অভ্যুত্থানবিরোধীদের এই বিক্ষোভ দেশটির বড় বড় শহরের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এরপর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অচলাবস্থার সূচনা হয়। প্রাত্যহিক বিক্ষোভ ও অবরোধের কর্মসূচির কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশ রুদ্ধ হওয়ায় অচল হয়ে গেছে দেশটির দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম।
বিক্ষোভের প্রথম পর্যায়ে সামরিক বাহিনী দৃশ্যত সংযমের পরিচয় দিলেও গতমাসের শেষদিক থেকে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকে। আন্দোলন দমনে রাবার বুলেট-জলকামান-টিয়ারশেলের পরিবর্তে প্রাণঘাতী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করেন মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে হওয়া বিক্ষোভের প্রথম থেকে সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত ও আটক হওয়া মানুষের হিসাব রেখে আসছে এএপিপি।
এএপিপির হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সী নিহতের নাম খিন মিও চিট। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় সাত বছর বয়সী এই শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার বাবাকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলি লেগেছিল খিন মিও চিটের গায়ে।
এছাড়া গুলিতে নিহত সবচেয়ে বয়স্ক বিক্ষোভকারীর নাম উইন কিয়ি। মার্চের ১৪ তারিখে আরও ৫০ জন মানুষের সঙ্গে ৭৮ বছর বয়সী উইনকেও গুলি করে হত্যা করে সামরিক বাহিনী।
১ ফেব্রয়ারি অভ্যুত্থানের পর বন্দি করা হয় মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চিকে। বর্তমানে তিনি কারা অন্তরীণ আছেন। এছাড়া তার দল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির পার্লামেন্ট সদস্যসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৩ হাজার সদস্যকে আটক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে মিয়ানমারে জাপানের অধিপত্য রুখতে সেনা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যা আঞ্চলিকভাবে পরিচিত ‘তাতমাদৌ’ নামে।
এর দু’বছর পর ১৯৪৭ সালে সেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতেই গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
সূত্র: রয়টার্স