নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই করোনাভাইরাস মহামারির তৃতীয় ঢেউ ঠেকানোর সুযোগ হারিয়েছে ইউরোপ। এবার তার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে- মহাদেশটি জুড়ে কঠোর লকডাউন চালু করার মধ্য দিয়ে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ ফ্রান্স প্যারিস ও নিস-সহ ১৬টি অঞ্চলে নতুন করে বিধি-নিষেধ আরোপ করে। তবে নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়া সত্ত্বেও জাতীয় পর্যায়ে আরেকবার লকডাউন চালু করতে রাজি নন প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাখোঁ।
গেল বছর মহামারিতে ইউরোপের প্রথম বিপর্যয়ের শিকার দেশ হয়েছিল ইতালি। আবারও সংক্রমণের বাড়ছে দেশটির কিছু এলাকায়। গত সোমবার থেকে রোম ও মিলানসহ ইতালির অধিকাংশ অঞ্চলে চালু করা হয়েছে কঠোর লকডাউন। অন্যদিকে, স্পেনে মাদ্রিদ ছাড়া অন্য সকল অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ আসন্ন ইস্টারের ছুটিতে নাগরিকদের ভ্রমণ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনের কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই চলমান লকডাউন শিথিল করার যে পরিকল্পনা করেছিলেন; সংক্রমণ সংখ্যাবৃদ্ধির নাটকীয় হার উল্লেখ করে-তা বাতিল করেছেন।
তবে সমালোচকদের মতে, নিষেধাজ্ঞার নতুন উদ্যোগগুলি নিতে দেরি হয়ে গেছে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি শিথিল করতে ইউরোপিয় রাজনীতিবিদদের অতি-আগ্রহের কারণেই আজকের এই অবস্থা।
“সবাই যাতে বড়দিনের কেনাকাটা করতে যেতে পারেন এজন্য সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হওয়ার আগেই লকডাউন তুলে নেওয়া হয়,” বলে অভিযোগ করেন ফরাসী মহামারি বিজ্ঞানী ক্যাথারিন হিল। তিনি জানান, লকডাউন তুলে নেওয়ার সময় ফ্রান্সে সংক্রমণ হার উচ্চ মাত্রাতেই ছিল। “তৃতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার পর প্রতিনিয়ত বাড়ছে হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে রোগীর ভিড়, প্যারিসসহ পুরো দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এই অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করেছে,” যোগ করেন ক্যাথারিন।
ইউরোপে সংক্রমণ হার বাড়ার পেছনে সার্স কোভ-২ জীবাণুর অতি-সংক্রামক ধরন- বি.১.১.৭ প্রধানত দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। গেল বছর যুক্তরাজ্যে প্রথম এটির সন্ধান মেলে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ধরনটির উপর প্রকাশিত প্রাথমিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এর প্রাণঘাতী সক্ষমতাও মারাত্মক।
ইতালির এল’আকিলা শহরে অবস্থিত সালভাতোর হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের পরিচালক আলেসান্দ্রো গ্রিমাল্ডি বলেন, “জীবাণুর অতি-সংক্রামক ধরন মহামারি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। যার কারণে রোগ বিস্তার রোধে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।”
যুক্তরাজ্যে সন্ধান পাওয়া ধরনটি দুই মাস আগেই ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মেলে, তখনই সতর্ক করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। ইউরোপে হু’র জরুরি পরিস্থিতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ক্যাথারিন স্মলউড বলেন, “জীবাণুর নতুন বংশজটি প্রচলিত ধরনে রুপ নিলে তা সংক্রমণ চিত্রের সার্বিক দশায় প্রভাব ফেলবে। যেকারণে, এর বিস্তার রোধে সামাজিক ও স্বাস্থ্য বিধিমালা আরও কঠোরভাবে আরোপ করতে হবে।”
ওই সতর্কবাণী এখন রুপ নিয়েছে নির্মম বাস্তবতায়। গত ১০ মার্চেই জার্মানির কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা যুক্তরাজ্যের ধরনটি দেশটিতে সংক্রমণের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বলে নিশ্চিত করে। ফ্রান্স ও ইতালিতেও একই চিত্র; অর্থাৎ নতুন করে আক্রান্তদের সিংহভাগের জন্যেই দায়ী এটি। স্পেনের ১৯টি অঞ্চলের মধ্যে ৯টি’তেই প্রধান উৎস বি.১.১.৭।
ইউরোপের নাজুক হাল যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি বিশ্বের জন্য সমূহ বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সতর্ক না থাকলে নতুন ধরনগুলো যে মহামারিকে দীর্ঘায়িত করবে- এমন ঝুঁকি এখন অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই। ইতোমধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষে বা আগামী এপ্রিলের প্রথমদিক নাগাদ এটি যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের প্রধান উৎস হয়ে উঠবে।
টিকাদানের মধ্যেই সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বাড়তে থাকলে আবারও হুমকির মুখে পড়বে হবে বিশ্ব অর্থনীতি। মহামারির অভিঘাতে জীবিকা হারানো কোটি কোটি মানুষের প্রাণ ও জীবনমান উভয়েই হবে বিপন্ন।
- সূত্র: সিএনএন