মনে করুন, আপনি চার সন্তানের মা। ১০ বছরে একের পর এক সব ক’টি সন্তান শিশুকালেই স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। কেমন মনের অবস্থা হবে আপনার?
এবার মনে করুন, আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে যে আপনি সব ক’টি সন্তানকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেছেন। চারটি ভয়ানক অপরাধের দায়ে আপনাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যদিও ওই অপরাধ আপনি করেননি। কিন্তু আপনি শাস্তি ভোগ করছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের হান্টার ভ্যালি এলাকার একজন মা ক্যাথলিন ফলবিগের প্রায় ১৮ বছর আগের অপরাধ নিয়ে এখন এরকম ভাষ্যই শোনা যাচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানান সিডনি থেকে সংবাদদাতা কোয়েন্টিন ম্যাকডারমট।
ক্যাথলিনকে ২০০৩ সালে খুনের মামলায় ‘অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ নারী সিরিয়াল খুনি’বলে আখ্যা দেয়া হয়। তার চার সন্তানকেই তিনি হত্যা করেছিলেন বলে দোষী সাব্যস্ত হন ও ৩০ বছরের কারাদণ্ডের ১৮ বছর সাজা তিনি ইতোমধ্যে খেটেছেন। কিন্তু এতদিন পর বিজ্ঞানীরা নতুন যেসব তথ্য নিয়ে এসেছেন তাতে এই মামলার রায় সঠিক কি না তা নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
গত সপ্তাহে ৯০ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ একটি পিটিশনে সই করে ফলবিগকে ক্ষমা প্রদর্শনের ও তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন দু’জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বর্ষসেরা অস্ট্রেলীয় খেতাব পাওয়া দু’ব্যক্তি, একজন প্রধান বিজ্ঞানী ও অস্ট্রেলীয় অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক জন শিন।
অধ্যাপক জন শিন বলেছেন, ‘এই মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে এখন যেসব বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাগত তথ্যপ্রমাণ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই আবেদনে স্বাক্ষর করাটাই যৌক্তিক মনে করছি।’
ফলবিগকে যদি মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে এটি হবে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে ভুল বিচারে শাস্তিপ্রদানের সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত।
পিটিশনে কী আছে?
ওই পিটিশনে বিজ্ঞান ও আইনের মধ্যে ব্যাখ্যায় যে বিশাল ফারাক রয়েছে তা উঠে এসেছে। ফলবিগের রায়ের বিরুদ্ধে বেশ ক’টি আপিল করা হয়েছিল। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া রায় ২০১৯ সালে যখন পুনঃবিবেচনা করা হয় তখনো অস্ট্রেলিয়ার আইনজীবীরা জানান যে তার দোষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তারা পরিস্থিতিগত তথ্যপ্রমাণ ও নিহত সন্তানদের মা ফলবিগের ওই সময়ের একটি ডায়েরিতে লেখা কিছু ধোঁয়াশা তথ্যের ওপরই মূলত জোর দেন।
‘ফলে আইনজীবীদের সামনে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর একটাই পথ খোলা ছিল যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। এটাই ছিল এ ক্ষেত্রে একমাত্র পদ্ধতি,’ বলছেন ওই সময় মামলার নেতৃত্বদানকারী সাবেক বিচারক রেজিনাল্ড ব্লাঞ্চ। তিনি আরো বলেন,‘তথ্যপ্রমাণ যা ছিল তাতে ফলবিগ ছাড়া আর কারো পক্ষে এই হত্যা করা সম্ভব ছিল না।’
নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সরকার জনগণকে দু’বছর আগে আশ্বস্ত করে যে, ‘তদন্তে কোনো ফাঁক রাখা হয়নি।’কিন্তু বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলছেন যে তাকে দোষী প্রমাণ করার পেছনে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তা উপেক্ষা করা যায় না,’বলেন মানবদেহের জিন বিশেষজ্ঞ গবেষক অধ্যাপক জোসেফ গেজ।
শিশু ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক ফিয়োনা স্ট্যানলি বলেন, ‘চিকিৎসাগত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণকে এ মামলায় অগ্রাহ্য করা হয়েছে। তবে বিজ্ঞানকে ছাপিয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত তথ্যের ওপর। ফলবিগ সন্তানদের মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের হাতে বিকল্প ব্যাখ্যা রয়েছে।’
কী সেই ব্যাখ্যা?
তারা বলছেন, ক্যাথলিন ফলবিগের শরীরে জিনগত একটি পরিবর্তন হয়েছিল। ওই পরিবর্তন বংশগতভাবে তার দুই মেয়ে সারা ও লরার শরীরে যায়। এ কারণেই দু’মেয়ের মৃত্যু হয়।
ক্যাথলিনের শরীরে জিনের আরেক ধরনের পরিবর্তন হয়, যা ধরা পড়েছে তার দুই ছেলে ক্যালেব ও প্যাট্রিকের ক্ষেত্রে। যা তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। যদিও এই পরিবর্তনটি নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন।
ফলবিগের দু’মেয়ের দেহে পরিবর্তিত ওই জিন ২০১৯ সালে প্রথম আবিষ্কার করেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভাসির্টির ইমিউনোলজি ও জিনোমিক মেডিসিনের অধ্যাপক ক্যারোলা ভিনুয়েসা। তিনিই সিরিয়াল খুনি হিসেবে পরিচিত ফলবিগের মুক্তির দাবিতে আবেদনের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘পরিবর্তিত এই নতুন ধরনের জিন কারো শরীরে এর আগে আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যাথলিনের শরীর থেকে এ জিন তার দুই মেয়ের শরীরে গেছে। ক্যালএমটু (CALM2) নামে এই জিন থেকে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
এই জিন সম্পর্কে আরো গবেষণা চালায় অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা ও আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। গত নভেম্বরে তাদের গবেষণার তথ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা ফলবিগের শরীরে পাওয়া ওই জিনের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখতে পান যে এটি বেশ মারাত্মক ধরনের। ওই জিন যেকোনো সময়ে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে। ছোট শিশুরা ঘুমের মধ্যে এর শিকার হয়ে মারা যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফলবিগের দুই মেয়েরই মারা যাওয়ার আগে প্রদাহ হয়েছিল। তারা মনে করছেন, ওই প্রদাহের কারণে দুই শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ এর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফলবিগের দুই ছেলের শরীরেও বিরল একধরনের জিন পাওয়া গেছে। ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, ওই জিন থেকে শিশু বয়সে দুরারোগ্য মৃগী রোগ হতে পারে, যার থেকে মৃত্যু অনিবার্য।
জিন বিষয় ওই গবেষণার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ফলবিগের চার সন্তানই স্বাভাবিক কারণে মারা গেছে।
মেলবোর্নের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক স্টিফেন কর্ডনার ২০১৫ সালে ওই শিশুদের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নতুন করে পর্যালোচনা করে মত দিয়েছিলেন, ওই শিশুদের খুন করার কোনো আলামত শরীরে নেই। দম বন্ধ করার কোনো লক্ষণও শিশুদের শরীরে ছিল না।
তিন বছর পর ২০১৮ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাথিউ অর্ড অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনকে বলেন, ‘অধ্যাপক কর্ডনারের সাথে আমি একমত যে ওই চারজন শিশুর প্রত্যেকেরই স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হয়েছে। এর স্বপক্ষে ব্যাখ্যা রয়েছে।’
ক্যাথলিন ফলবিগের ভাগ্য এখন নির্ভর করছে ওই পিটিশনের ওপরে। নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি আপিল আদালতে সম্প্রতি তার আরেকটি আবেদনের শুনানি হয়েছে। ফলবিগ প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন তিনি নির্দোষ। সূত্র : বিবিসি