ঘুম আল্লাহর একটি অশেষ নেয়ামত। মহান রাব্বুল আলামীন একটি দিনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, অর্ধেক আলোকিত অর্থাৎ দিন অপর অর্ধেক অন্ধকার মানে রাত। যাতে তাঁর বান্দারা সারাদিন রোজগারের উদ্দেশ্যে পরিশ্রম করে রাতে ঘুমিয়ে সেই ক্লান্তি দূর করতে পারে। এই ঘুম যার যত গভীর হয়, ততোই সে সতেজ ও সুস্থ বোধ করে। এই ঘুমের সময়েও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল। এগুলো করলে বান্দা ঘুমের সময়টাতেও আল্লাহর রহমত ও পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয় না।
মুমিনের প্রতিটি কাজই ইবাদত। ঘুমও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুমায়, তার ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। রাতে ঘুমানোর
আগে কিছু করণীয়-বর্জনীয় কাজ রয়েছে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
* এশার নামাযের পর গল্প-গুজব, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কোনো বিনোদন উপভোগে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত। রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর
গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৭৯) এই সুন্নাত পালন করলে শেষ রাতে
তাহাজ্জুদের জন্য ওঠা এবং ফজরের নামায আদায় করা সহজ হয়।
* ঘুমানোর পূর্বে পেশাব-পায়খানা করে নেওয়া উত্তম।
* ঘুমানোর পূর্বে বাতি ও আগুন নিভিয়ে নেওয়া সুন্নাত। বিশেষ প্রয়োজন না হলে ডিম লাইটও জ্বালিয়ে ঘুমানো ঠিক নয়। কারণ অন্ধকার শরীর থেকে ঘুমের সময়
মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে, যা শান্তির ঘুমের সহায়ক। মেলাটোনিন মাথায় পিনেয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হওয়া এক বিশেষ ধরনের হরমোন, যা বুদ্ধি
বাড়ায়।
* ঘুমানোর পূর্বে খাদ্য-খাবার ও পানির পাত্র ঢেকে দেয়া সুন্নাত। ঢাকার জন্য কোন কিছু না পেলে অন্তত একটি লাঠি দিয়ে হলেও ঢেকে রাখতে হবে। খাবারদাবার
ভালোভাবে না ঢাকলে পোকা-মাকড় খাবারে এসে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
* মেসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করে উযু অবস্থায় ঘুমানো সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান রাতে আল্লাহকে স্মরণ করে অজু শেষে শয়ন করে এবং
রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা তা দান করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
* উভয় চোখে তিনবার করে সুরমা লাগানো সুন্নাত। নবী (সা.) ঘুমানোর আগে ডান চোখে তিনবার এবং বাঁ চোখে তিনবার সুরমা লাগাতেন। (শামায়েলে তিরমিজি,
হাদিস : ৪১) বিশেষজ্ঞদের মতে, সুরমা চোখের জন্য ছোঁয়াচে সব ধরনের রোগ-জীবাণু ও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধক জীবাণু ধ্বংস করে। চোখে জ্বালাপোড়া নিরাময়
করে।
* ডান কাতে শোয়া সুন্নাত। এর মানে এই নয় যে, সারা রাত আর বাঁ দিকে কাত হওয়া যাবে না। প্রথমে অন্তত কিছুক্ষণ ডান হাত গালের নীচে রেখে ডান কাতে শোয়া
উচিত। নবী করীম (সা.) এভাবে ঘুমাতেন। ডান কাত হয়ে ঘুমালে আমাদের হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস ইত্যাদির অবস্থান স্বাভাবিক থাকে, যা বাঁ কাত হয়ে ঘুমানোর
চেয়ে বেশি উপকারী।
* ঘুমের সময়ে সূরা মূলক তিলাওয়াত করা সুন্নাত। আয়াতুল কুরসী পাঠ করাও সুন্নাত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি
পড়বে। তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩১১)
* দূরূদ শরীফ পড়া এবং তাসবীহে ফাতেমী অর্থাৎ ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া সুন্নাত।
* সূরা এখলাস, ফালাক ও নাছ পড়ে হাতে ফুঁক দিয়ে সমস্ত শরীরে তিনবার বুলানো সুন্নাত। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন,
তখন দুই হাত একত্র করে তাতে সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যত দূর সম্ভব দেহে তিনবার দুই হাত
বোলাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০১৭)
* সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত পাঠ করা সুন্নাত। কোনো ব্যক্তি ঘুমানোর আগে বাকারার তিন আয়াত পড়লে তা গোটা রাতের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হবে। রাসুল
(সা.) ইরশাদ করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সুরা বাকারার শেষ তিনটি আয়াত পাঠ করে, তবে এটিই তার জন্য যথেষ্ট। (বুখারি, হাদিস : ৫০৪০)
* সুরা মুলক পাঠ করা সুন্নাত। রাসুল (সা.) বলেছেন, কোরআনের মধ্যে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে, যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে
দেওয়া হয়। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক)। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯১) রাসুল (সা.) এই সুরা না পড়ে তিনি কখনো ঘুমাতে যেতেন না।
(তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯২)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৫৬)
ঘুমানোর আগে হাদীছ শরীফে অনেকগুলো দোয়া বর্ণিত হয়েছে। তবে সব দোয়া পড়তে না পারলেও ছোট্ট এই দোয়াটি পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া
আহ্ইয়া’, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনর্জাগ্রত হব।’