হোয়াইট হাউজে একটি ট্রান্স আটলান্টিক শিল্পকর্ম নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। উত্তেজনায় টগবগ পরিবেশ, বিভ্রান্তিকর এবং প্রচ্ছন্ন বর্ণবাদের চিহ্ন নিয়ে এখনো টিকে রয়েছে সেই তর্ক। সেটি আর কিছুই নয়, হোয়াইট হাউজে প্রয়াত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আবক্ষ মূর্তি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওভাল অফিস থেকে সেই মূর্তি সরিয়ে দিয়েছেন। তার পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প এতো দিন সেটি সযত্নে রেখেছিলেন। তিনি চার্চিলকে ‘যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী টাইপ কিছু’ মনে করতেন।
বাইডেন অবশ্য ওভাল অফিসের অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছেন। তিনি জানালার পর্দাসহ নতুনভাবে সাজিয়েছেন তার কার্যালয়। সেখানে নতুন করে স্থান পেয়েছে, লাতিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা সিজার শ্যাভেজ, রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, রবার্ট এফ কেনেডি, রোজা পার্কস এবং এলেনোর রুজভেল্ট।
চার্চিলের আবক্ষ মূর্তি সরানোর ঘটনা এর আগেও ঘটেছিল এবং তখন তা নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যায়। আমেরিকান রক্ষণশীল এবং এমনকি কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদও এটিকে একটি বড় চপেটাঘাত বলে বিবেচনা করেছিলেন।
আরকানসাসের সাবেক গভর্নর মাইক হাকাবি বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্ভবত এই শুনে শুনে বড় হয়েছেন যে, এই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা আসলে তার পূর্বপুরুষদের নির্যাতনকারী।
টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ বলেন, এই যে ওভাল অফিসের সজ্জা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এটি পরবর্তী ছয় বছরে যা কিছু ঘটবে সেটিরই পূর্বনিদর্শন।
তত্কালীন লন্ডনের মেয়র এবং বর্তমানে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আরো কঠোর মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ কেনিয়ায় বসবাসরত তার পূর্ব পুরুষদের অপছন্দ বলেই সম্ভবত প্রেসিডেন্ট এই পরিবর্তনটা করেছেন।
প্রায় সব পক্ষের আক্রমণগুলো ভয়ানক বর্ণবাদী এবং বিভ্রান্তিকরও ছিল। এমন প্রতিক্রিয়ায় ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তারা চরম ক্ষুব্ধ হন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ওবামাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাস গড়েন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এমন আরো অনেক বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে।
ব্রিটিশ আধুনিকতাবাদী ভাস্কর স্যার জ্যাকব এপস্টেইনের তৈরি চার্চিলের দুটি অভিন্ন আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। লিন্ডন বি জনসন প্রশাসনের সময় থেকে এর একটি হোয়াইট হাউজের সংগ্রহে রয়েছে। আরেকটি প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে হোয়াইট হাউজে রাখার জন্য দিয়েছিলেন। বুশ যতোদিন ছিলেন আগেরটির পাশাপাশি সেই আবক্ষ মূর্তিটিও হোয়াইট হাউজে ছিল। এরপর সেটি আবার ব্রিটিশ সরকারকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ওবামার অধীনে হোয়াইট হাউজের মালিকানাধীন সংস্করণটি আর ওভাল অফিসে প্রদর্শিত হয়নি। এর পরিবর্তে ওবামা সেটিকে তার আবাসের ট্রিটি রুমে রেখেছিলেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বা সন্ধ্যায় বাস্কেটবল দেখতে যেতে চাইলে যাওয়ার পথে মূর্তিটি চোখে পড়তো। তার কথায়, মূর্তি সেখানে রাখার কারণ হলো তিনি যাতে ব্যক্তিগত সময়ে সেটি দেখতে পান। ওবামার ওভাল অফিসে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের একটি আবক্ষ মূর্তিও স্থান পেয়েছিল।
শাসনামলের শেষ বছরে এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন ওবামা। তিনি লন্ডন সফরের সময় বলেছিলেন, আমি লোকটিকে (চার্চিল) ভালোবাসি। সেখানে এতোগুলো টেবিল, জিনিসপত্র একটু ছড়িয়ে সাজিয়ে না রাখলে অগোছাল লাগবে।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই চার্চিলকে ওভাল অফিসে ফিরিয়ে আনেন। ব্রিটিশরা তাতে খুশিই হয়েছিল। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মে, যিনি ওভাল অফিসে ট্রাম্পের প্রথম বিদেশী দর্শনার্থী ছিলেন, তিনি ট্রাম্পকে উপহার দেয়ার জন্য চার্চিলের আবক্ষ মূর্তির যুক্তরাজ্য সংস্করণ সঙ্গে করে এনেছিলেন। অবশ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের লোকজন আসলে এটি চেয়েছিলেন বলেই আনা হয়েছিল।
টেরিসা মে সাক্ষাৎকালে ট্রাম্পকে বলেছিলেন, আপনি এটি আবার গ্রহণ করেছেন বলে আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি।
এখন আবার চার্চিলের সেই আবক্ষ মূর্তি ওভাল অফিস থেকে সরানো হলো। তবে স্বয়ং বরিস জনসন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কোনো টুঁ-শব্দ করেননি। তিনি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয় ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ওভাল অফিস হলো প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত কার্যালয়। সেটি প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা অনুযায়ীই সাজাতে হয়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে ইঙ্গ-মার্কিন সম্পর্কের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছেন।
সূত্র: সিএনএন