করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিনগুলোতেই করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩০৬ দিন হাসপাতালে কাটানোর পর সুস্থ হয়ে বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরেছেন যুক্তরাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী।
গত বছরের মার্চের শেষদিকের এক সকালে খাবার টেবিলে বসে অসুস্থ হয়ে পড়েন জোফ্রি উলফ নামে ৭৪ বছর বয়সী ওই ভদ্রলোক। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালে যতদিন কাটিয়েছেন, তা যেকোনো কোভিড রোগীর পক্ষে সর্বোচ্চ সময়কাল বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল, গ্রীষ্মের সময় তার তিন ছেলেকে ডাকা হয়েছিল বাবাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্যে। কিন্তু উলফের ছেলেদের ভাষ্যে, জুলাইয়ে ‘বাবা যেন হঠাৎ জেগে উঠলেন’।
হুইটিংটন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাকে ভর্তি করা হয় লন্ডনের পাটনিতে অবস্থিত রয়্যাল হসপিটাল ফর নিউরো-ডিজ্যাবিলিটি তে। ভাইরাসের কারণে হওয়া মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে তাকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিল। এছাড়াও ভাইরাসের আক্রমণে তার শরীরের একাংশ অবশ হয়ে গেছে এবং কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
উলফ জানিয়েছেন তিনি হুইটিংটন ও রয়্যাল দুটি হাসপাতালেরই ডাক্তার ও স্টাফদের ব্যবহারে খুবই সন্তুষ্ট। উলফ এতদিন পর নর্থ লন্ডনের হলোওয়েতে নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত এবং উলফ এর কাছে এই ফেরার মানেই হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার আগে উলফ লন্ডনের সিটি লিট অ্যাডাল্ট এডুকেশন কলেজে আর্ট হিস্টোরি বিষয়ে একটি ডিগ্রী নেয়ার জন্যে অধ্যয়নরত ছিলেন। এছাড়াও উলফ নিয়মিত জিমে যেতেন ও শরীরচর্চা করতেন এবং তার কোন বিশেষ শারীরিক সমস্যাও ছিলনা। তাই তার হঠাৎ এত অসুস্থ হয়ে পড়া যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ছিল। ২৩ শে মার্চ তার ছেলেরা ৯৯৯ এ কল দেয়ার পর ডাক্তাররা এসে তাকে দেখেন।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয় ১২৭ দিন ধরে, যার মধ্যে ৬৭ দিন তিনি পার করেছেন ভেন্টিলেটরের মধ্যে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ের ফুটেজে দেখা যায় নিউরোলজিক্যাল পুনর্বাসনে যাওয়ার আগে তার প্রশংসা করছেন অনেকে।
উলফ এর ছেলে নিকি তার বাবার কথা বললেন, ‘এটা ছিল খুব দীর্ঘমেয়াদি একটা সংগ্রাম। কিন্তু এতদিন অসুস্থ থাকার পরেও তার হাস্যরসবোধ একটুও কমেনি। বাড়ি ফেরার পর তার প্রথম জোক ছিল এই যে, তিনি ট্রাম্প শাসনের শেষ বছরটা বাদ দেয়ার জন্যে এই বিশেষ ব্যবস্থায় গিয়েছিলেন!
নিকি এবং উলফের আরেক ছেলে স্যাম এই পুরো যাত্রায় বাবাকে সবসময় সাহায্য করেছেন। হাসপাতালে উলফ এর সময় কাটতো সাহিত্য পড়ে । তিনি ই-বুক এর অডিওতে জেন অস্টিন এর ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রিজুডিস’ শুনতেন । এখান থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ‘বুকস ফর ড্যাড’ প্রজেক্ট এর ধারণা পায় এবং তারা অন্য কোভিড রোগীদের জন্যেও হালকা অডিও বই শোনার ডিভাইস দেয়। উলফ এর ছেলেরাও হাসপাতালে যারা তার বাবাকে দেখাশোনা করেছেন এবং পাশে ছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারা বাবাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব।
তবে কেট গ্যারাওয়ে নামের এক নারী জানিয়েছেন যে তার স্বামী ডেরেক ড্র্যাপারও হাসপাতালে একটি লম্বা সময় পার করে টিকে আছেন , কিন্তু তার শরীর থেকে করোনাভাইরাসের উপসর্গ এখনো যায়নি।
আরোগ্য লাভের আরো তিনটি অসাধারন গল্প
করোনাভাইরাসের নতুন ওয়েভে যুক্তরাজ্য জুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ের কিছু অবিশ্বাস্য গল্পও উঠে এসেছে।
ম্যারি নিকোলসন
নতুন বছরের প্রথম দিনেই করোনা পজিটিভ হলেও শতবর্ষী মানবী ম্যারি কিন্তু ঠিকই সুস্থ হয়ে নিজের ১০৬ তম জন্মদিনের উৎসবে যোগ দিতে পেরেছেন। ‘পলি’ নামে পরিচিত এই নারী দ্য গার্ডিয়ান কে বলেন, “এটা খুব বড় একটা জন্মদিনের উৎসব আমার জন্যে। আমি নিজে খুব আনন্দিত এবং উপভোগ করছি সবকিছু। এর আগে আমার সামান্য সর্দি থাকলেও এখন আমি ভালো বোধ করছি। করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে আমি খুবই উজ্জ্বীবিত অনুভব করছি এবং কোনোকিছুই আমায় থামাতে পারবে না। আমি শীঘ্রই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই।”
নিকোলাস সিনোট
হাসপাতালে ২৪৩ দিন কাটানোর পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েস এর পাইলট নিকোলাস সিনোট। মার্চের দিকে তাকে টেক্সাসের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। দুই সন্তানের জনক সিনোট বলেন, “আমি আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায় পার করে এসেছি। আমাকে অনেক রকম মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে এর মধ্যে।”
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে যে সিনোট হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আনন্দে শূন্যে ঘুষি দিচ্ছেন এবং হাসপাতাল স্টাফদের আলিঙ্গন করছেন। ৫৯ বছর বয়সী সিনোট জানান, তার স্ত্রী নিক্কি তাকে অনেক সহায়তা করেছেন এই সময়ে সেরে উঠতে। তিনি প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে তাকে দেখতে আসতেন।
ডাক্তাররা জানান, নিকোলাস সিনোটের শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে পাইলট হিসেবে তার শারীরিক ফিটনেসও তাকে সাহায্য করেছে টিকে থাকতে। প্রচুর ঔষধ নেয়ার পর তিনি অবশেষে সুস্থ হন। আরেকজন ডাক্তার বিশ্বজিৎ কর বলেন, “আমরা অনেক বেশি খুশি যে এতোটা অসুস্থ কেউও সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছেন।”
অ্যান্থনি সিরি
বিলিংহাম এর ৫৮ বছর বয়সী এইচজিভি ডাইভার সিরি তার চাকরি থেকে সাময়িক ছুটিতে থাকার সময়টাতে অসুস্থ হয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তির প্রায় সাড়ে তিন সপ্তাহ পর সিরির জ্ঞান ফেরে এবং এক ভিডিওতে দেখা গেছে এই ‘জেগে ওঠা’র কথা বলতে গিয়ে আবেগী হয়ে পরেন সিরি। সিরির অক্সিজেন মাত্রা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার পর তার স্ত্রী জয়েস অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন এবং তাকে স্টকটোনের নর্থ টিস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালে আসার পরপরই যখন সিরি কোমায় চলে যান, সে সময়টা তার পরিবারের জন্য খুব কঠিন ছিল বলে জানান সিরি। তারা সবাই ভেবেছিলেন যে সিরি আর সুস্থ হবেন না।শুধুমাত্র টিউব খোলার দিনই সিরি কথা বলতে সক্ষম হন এবং দীর্ঘ এক মাস বাদে স্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলেন।
অ্যান্থনি সিরি নিজের অবস্থার কথা জানানোর পর সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করেন তারা যেন করোনাভাইরাসকে গুরুত্বের সাথে নেয় এবং সচেতন থাকে।