বিগত কয়েক মাস ধরেই ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে সকল জাতিকে একজোট হয়ে সমতার ভিত্তিতে টিকা বণ্টনে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। কিন্তু, প্রভাবশালী দেশগুলো তাতে কান দেয়নি। তার ফলে হু’ও ধৈর্য হারাচ্ছে।
গত সোমবার হু’ মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস অভিযোগ করেন, মুনাফার পরিমাণ বেশি হওয়ায় (পশ্চিমা) ওষুধ উৎপাদক সংস্থাগুলো ধনী দেশে টিকা অনুমোদন পেতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি তারা আবিষ্কৃত টিকার মান সম্পর্কিত দরকারি কাগজপত্র জমা দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ অনুমোদন নিতেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর ফলে কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে দরিদ্র দেশে টিকা বিতরণের উদ্যোগে আরও দেরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
গেব্রেয়াসুস বলেন, “বিশ্ব আজ বিবেকের চরম ব্যর্থতার মুখে দাঁড়িয়ে। তারা সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের কথা বললেও- কিছু দেশ এবং কোম্পানি কোভ্যাক্সকে এড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রতি জোর দিচ্ছে। এরফলে টিকার দাম যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি শুরু হয়েছে সবার আগে ভ্যাকসিন কেনাবেচার এক প্রতিযোগিতা। নিঃসন্দেহে এটা অন্যায়।”
সীমিত তহবিল নিয়ে কোভ্যাক্স এর মাধ্যমে টিকা কিনতে গিয়ে হু’ যে সমস্যায় পড়েছে, তারফলে চীনের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতির নতুন সুযোগ। বেইজিং যে সুযোগটি হাতছাড়া করবে না, তার ইঙ্গিতও মিলছে। গত সপ্তাহেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ১০ লাখের বেশি টিকা ডোজ সরবরাহের ঘোষণা দেন।
চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এর মাধ্যমে চীন ভূ-কৌশলগতভাবে একটি বড় জয় পেল। জো বাইডেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ফিরিয়ে এনে সংস্থাটিকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেছিলেন।
“২০২০ সালে চীন মাস্ক কূটনীতি দেখিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে তৎপর হয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে,” মন্তব্য করেন ইয়ান স্টোরে। তিনি আইএসইএএস- ইউসুফ ইসহাক ইনস্টিটিউড নামক সিঙ্গাপুরে অবস্থিত একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও উন্নয়ন রাজনীতি নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থার সিনিয়র ফেলো।
তার মতে, “দুটি নীতিরই এক লক্ষ্য: দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সংখ্যা বাড়ানো এবং মহামারী যে চীন থেকে হয়েছিল সেটা সবার মন থেকে মুছে ফেলা।”
সাম্প্রতিক সময়ে, নানা দেশে শীর্ষ পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে চীনে তৈরি টিকাগুলো। যেমন; বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো ইয়োদোদো নিজে সিনোভ্যাক বায়োটেক উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ টিকা নেন। তার টিকাগ্রহণ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। টিকাটির নির্ভরযোগ্যতার তথ্য সম্পর্কে যে উদ্বেগ আছে, তাতে তিনি বিচলিত হননি।
গত সোমবার থেকে সিনোভ্যাকের ৬০ লাখ ডোজ বিতরণ শুরু করেছে ব্রাজিল। অথচ গেল বছর চীনের টিকা নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো। তার সেই অবস্থান যেন পুরোটাই পাল্টে গেছে।
‘আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়’
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হূন সেন গত মাসে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পায়নি এমন কোনো টিকা তার দেশ ব্যবহার করবে না। গত সপ্তাহে সেই অঙ্গীকার ভেঙ্গে চীন থেকে আসা ১০ লাখ ডোজ গ্রহণ করে দেশটির সরকার। এসময় হূন সেন ইন্দোনেশিয়া, মিশর ও চীনে টিকাটির ব্যাপক ব্যবহারকে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং নিজেও টিকাটি নিয়েছেন এবং তারপর তিনি বিদেশ ভ্রমণের মতো সুস্থও আছেন।
“প্রাণঘাতী এই মহামারী থেকে জাতীয় সুরক্ষা এবং জনগণকে নিরাপদ রাখার জন্যে আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না,” মন্ত্রীসভা বৈঠক পরবর্তী এক সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে একথা বলেন কম্বোডীয় প্রধানমন্ত্রী।
সেখানে আরও বলা হয়, “একারণে, শুধুমাত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত টিকা ব্যবহার নিয়ে গতবছর আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম- তা আমার সরকার পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্ভরযোগ্যভাবে টিকার কার্যকারিতা ও মান পরীক্ষার সক্ষমতা অনেক দেশেরই নেই। একারণে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা অনুমোদনের উপর আস্থা রাখে। এই নির্ভরতার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে মুনাফা সন্ধানী পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ধনী দেশ নির্ভরতায়। তারা প্রয়োজনীয় তথ্য না দিলে, তাদের টিকাও সংস্থাটির অনুমোদন অনেক দেরিতে পাবে। ফলে থাকবে না কোভ্যাক্স জোটে ডোজ সরবরাহের চাপ। বরং, তারা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমেই ধনী দেশে সরকারের কাছে বিপুল চালান বিক্রি অব্যাহত রাখতে পারবে আবার মধ্য আয়ের দেশেও উচ্চ দামে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে।
সেকারণেই, হু’র অনুমোদন না পেয়েও দরিদ্র ও মধ্য আয়ের অনেক দেশের কাছে বিকল্প হয়ে উঠছে চীন ও রাশিয়ায় তৈরি ভ্যাকসিন।
এপর্যন্ত মাত্র একটি টিকা; ফাইজার/ বায়োএনটেকের তৈরি কোভিড-১৯ প্রতিষেধককে স্বীকৃতি দিয়েছে হু। অতি-দরিদ্র কোনো দেশেই টিকা উৎপাদিত হচ্ছে না। অন্যদিকে, ফাইজার ও মডের্না ইঙ্কের ৮৫ শতাংশ টিকার চালান অগ্রিম কিনে রেখেছে ধনী দেশসমূহ। লন্ডন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এয়ারফিনিটি লি. সূত্রে এতথ্য জানা গেছে।
চীন কোভ্যাক্স উদ্যোগে সহযোগিতার ঘোষণা দিলেও, দেশটির উৎপাদিত কোনো টিকা হু’র স্বীকৃতি পায়নি। এব্যাপারে সিনোভ্যাকের এক মুখপাত্র জানান, করোনাভ্যাক নামক তাদের টিকাটি অনুমোদনের জন্য কোম্পানিটি হু’র কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই, চীনে পৌঁছে গেছেন হু’র একদল পরিদর্শক, তারা নির্দিষ্ট সময় কোয়ারেন্টিনে থাকা শেষে খুব শিগগির সিনোভ্যাকের টিকা উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ পুরো বিশ্বে ২শ’ কোটি টিকা ডোজ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়েছে কোভ্যাক্স। এরফলে উদ্যোগটিতে অংশ নেওয়া সকল দেশের মাত্র ৩ শতাংশ জনগণকে আগামী জুলাই নাগাদ সুরক্ষিত করা যাবে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় হু’র তালিকায় থাকা ১১টি প্রার্থী টিকা নানা দেশে অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু, ফাইজারেরটি ছাড়া অন্যদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সম্ভাবনাময় অন্য টিকাগুলোর মধ্যে আছে অক্সফোর্ড/ অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং মডের্না ইঙ্কের তৈরি দুটি প্রতিষেধক। কিন্তু, হু’র অনুমোদন না থাকায় সেগুলো কোভ্যাক্সের মাধ্যমে কেনা ও বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর এই অনুমোদনে দেরির জন্য পশ্চিমা সংস্থাগুলোর অনীহাকেই দায়ী করছে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষটি।
হু’ মহাপরিচালকের বক্তব্য ছিল তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিলেন, কিছু বাণিজ্যিক সংস্থার মুনাফালোভী স্বার্থপর আচরণের কারণে ক্যাভ্যাক্সের মাধ্যমে টিকা বিতরণে দেরির ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
আর সেই সুযোগেই আন্তর্জাতিক কূটনীতির ময়দানে নিজ অবস্থান শক্তিশালী করে নিতে পারছে বেইজিং।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ