ভারত আধিকৃত কাশ্মিরের মুক্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। কাশ্মিরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমনন্সের ওয়েষ্ট মিনিষ্টার হলে গত বুধবার আয়োজিত এ বিতর্কে অংশ নিয়ে অন্তত একজন মন্ত্রী ও দশজন এমপি কাশ্মিরিদের ওপর চলমান ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সকল তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে কাশ্মিরিদের ইচ্ছা আনুযায়ী তাদের নিজেদের পরিচালিত করার অধিকার বাস্তবায়নের দাবি করেন।
বিতর্কে অংশ নিয়ে সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি কাশ্মিরি গ্রুপের নেতা এমপি সারা ব্রিটক্লিফ জানান, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক নিয়ন্ত্রণে নিগৃহীত হচ্ছে কাশ্মিরের নারী-পুরুষ ও শিশুরা। ভারত আধিকৃত কাশ্মিরে গণহত্যা বন্ধ করতে বিশ্বের সমর্থন দরকার সেখানকার নির্যাতিত মানুষদের।
ব্রাডফোর্ড ওয়েষ্ট এলাকার লেবার দলীয় এমপি নাজ শাহ জানান, কাশ্মিরে গণহত্যার খবর বাইরের দুনিয়ার মানুষ জানতে পারছে না। কারণ, মিডিয়াকে ব্লাক আউট করে রাখা হয়েছে। সেখানে নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে, গুম করে পেলা হচ্ছে; নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে; সেখানে চলছে জাতিগত নির্মূল অভিযান।
এই ব্রিটিশ মুসলিম মহিলা এমপি প্রশ্ন করেন, যেখানে গণমাধ্যমে খবরাখবর প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে, যেখানে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না; সেখানে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউজ কী করে নিশ্চিত হবে যে কাশ্মিরে জেনোসাইড চলছে না?
মিসেস শাহ তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে বলেন, ৭০ লাখ কাশ্মিরিকে দমিয়ে রাখতে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে পাঁচ লাখ সৈন্য। ব্রিটিশ সরকার ভারতের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে । ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অর্ধ বিলিয়ন পাউন্ডের অস্ত্র দিয়েছে ভারতকে। আর সেই অস্ত্র দিয়ে কাশ্মিরিদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে।
তিনি ব্রিটিশ সরকারকে আহবান জানান, এখনো সময় আছে, কাশ্মিরিদের রক্ষায় সক্রিয় হোন, নয়তো ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি কাশ্মিরি গ্রুপের আরেক এমপি জেমস বেরি ডালি জানান, তিনি গত বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে পার্লামেন্টারি দলের সদস্য হয়ে কাশ্মিরে সফরে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে শুনে এসেছেন। এখন সেখানে চলছে করোনার নামে লকডাউন। আসলে এটা বরং কাশ্মিরিদের মৌলিক মানবাধিকারকে আরো বেশি দলিত করছে। নারী নির্যাতন, গুম, হত্যা এসব এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ সবের খবর পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ভারত তাদের অধিকৃত কাশ্মিরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের উপর যে বর্বরতা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সভ্য দুনিয়াকে সোচ্চার হতে হবে।
কনজার্ভেটিভ দলের এমপি রব্বি মুর বলেছেন, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা অন্য দেশের নীতি নির্ধারণ করে দিতে পারে না। তবে কাশ্মিরের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে তদন্ত হোক সেটা অন্তত বলতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই ব্রিটেনের বন্ধু, উভয় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ব্রিটেনে বসবাস করছে। তাদের কথা ভেবে এবং পারমাণু শক্তিধর দু’টি প্রতিবেশি দেশের সঙ্ঘাতের কথা চিন্তা করে কাশ্মির প্রশ্নে দ্রুত একটা সমাধান বের করতে হবে।
লেবার দলীয় আরেক এমপি জন স্পেলার বলেন, আমরা ভারতের বিরুদ্ধে নই। তাই বলে কাশ্মিরে যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে সে সম্পর্কে ভারতকে দায়ী না করে নীরব থাকতে পারি না। কাশ্মির বা পাঞ্জাবে ভারতীয় সৈন্যরা যে নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলেও মেনে নিতে পারি না।
এ সময় ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব ষ্টেট জাষ্টিস রবার্ট বাকল্যান্ড কাশ্মিরের ওপর থেকে সবরকম নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ভারত সরকারকে আহবান জানান। তাছাড়া দিল্লিস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের একটি প্রতিনিধি দলকে অবরুদ্ধ কাশ্মির সফর করে বাস্তব অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দেয়ারও দাবি জানান রবার্ট বাকল্যান্ড।
বিতর্কে অংশ নিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী নাইজেল এডামস বলেছেন, দীর্ঘ বছর ধরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সঙ্ঘাতের একটি কারণ হয়ে রয়েছে কাশ্মির। তবে কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী এ সঙ্কটের সমাধান হতে হবে।
আজাদ-কাশ্মির প্রেসিডেন্টের সন্তোষ প্রকাশ
আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট সরদার মাসুদ খান কাশ্মিরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিবাচক মতামতকে দারুণভাবে প্রশংসা করেছেন।
এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে সরদার মাসুদ খান কাশ্মিরিদের মুক্তির বিষয়টিকে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরার জন্য আনুরোধ জানান।
তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ব সম্প্রদায় এত দিনে কাশ্মির নিয়ে ভারতের শঠতা ও ধূর্তমি বুঝতে পেরেছে। সত্যিকার অর্থে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের জন্যই কাশ্মির সঙ্কটের সমাধার করতে হবে কাশ্মিরিদের ইচ্ছা অনুসারে। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবে।
কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় : পাকিস্তান
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বলেছেন, কাশ্মির প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ এ বিতর্কের মাধ্যমে তাদের পক্ষে কূটনৈতিক বিজয় সূচিত হয়েছে। কাশ্মির যে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয় সেটাও বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কাশ্মির প্রসঙ্গে আলোচনায় অবান্তর এবং তৃতীয় পক্ষের প্রচারণার বিষয়বস্তু গুরুত্ব পেয়েছে; যার কোনো বাস্তব গুরুত্ব নেই।