spot_img

জঙ্গিবাদের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জানালেন তারা

অবশ্যই পরুন

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় ৯ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) র‌্যাব সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় স্বরাষ্টমন্ত্রী ও আইজিপি জঙ্গিদের তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেন।

জঙ্গিবাদ থেকে ফেরত আসা এসব তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে সহযোগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, র‌্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তারা বলেন, আমরা ভুল পথে ছিলাম। এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে দেশের জন্য কাজ করতে চাই। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।

শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪) সিলেটের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরে যুক্ত হন।

শওকত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন আমি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় বিভিন্ন পোস্ট দেখে আকৃষ্ট হই। ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামের দাওয়াতি শাখায় কাজ শুরু করি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। এক পর্যায়ে আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে মোটিভেট করে সংগঠনে যুক্ত করতে সক্ষম হই। তবে এখন পর্যন্ত আমি নিজে কখনো কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হইনি।

সংগঠনের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনায় আমি দাওয়াতি শাখা থেকে সংগঠনের প্রশিক্ষণ বিভাগের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত হই। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে আমি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছিলাম না। নিজের কোনো সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছুই ছিলো না। পরে আমি নিজেকে জঙ্গি সংগঠন থেকে বের করে আনতে বাধ্য হই। তবে ওই সময়টা আমি পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করি।

শওকত আরো বলেন, একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারি যে, আমি ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার হয়েছিলাম। তখন নিজেই অনুশোচনার মধ্যে পড়ে যাই। আমার ভেতরে নতুন বোধ উদয় হয়। আমি পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি।

‘তখন আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুরুতে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে থাকলেও র‌্যাব আমার ভয়-ভীতি, দ্বিধা সব দূর করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সাহস দেয়।

তিনি বলেন, আমি যে পথে হেঁটেছি, তা ভুল পথ। তরবারির ঝনঝনানি, এটা সেই যুগের (আগের যুগ) কথা। এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ, শিক্ষার যুগ। মননশীলতা, চিন্তা সৃষ্টিশীলতার যুগ। ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী গড়ে তোলার যুগ। আমরা কেউ যেন ইসলাম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যায় প্রভাবিত না হই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আসুন আমরা ইসলাম অনুসরণ করি, একটা সত্য সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলি। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সঠিকভাবে তুলে ধরি।

ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯) সিলেটের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী থাকাবস্থায় জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য শওকতের সঙ্গে বিয়ে করেছিলেন। মূলত স্বামী শওকত তাকে উগ্রবাদের দিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে সে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার কারণে নুসরাত ঢাকায় কয়েকটি হাসপাতালে তার পরিচয় গোপন রোখে খণ্ডকালীন চাকরি করেছিলেন। বর্তমানে তিনিও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা আরেকজন আবিদা জান্নাত আসমা ওরফে রাইসা (১৮)। ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়, এরপর গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেন ওই যুবককে। এরপর বিদেশে পড়তে যান। এরইমধ্যে স্বামীর উৎসাহে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

এই তরুণী বলেন, প্রেমের সূত্র ধরে ২০১৮ সালে পরিবারের অনুমতি ছাড়াই তাকে বিয়ে করি। পরবর্তীতে পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে চলে চাই। সে সময় আমার স্বামীও আমার সঙ্গে দেশের বাইরে যায়। মূলত এটা তারই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়। কিন্তু আমার পরিবার জানতো না।

তিনি জানান, ছয় মাসের মতো আমরা দেশের বাইরে ছিলাম। এরপর আবার দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে আসলেও আমার পরিবার জানতো না। দেশে ফিরে আমি আর আমার স্বামী প্রায় দেড় বছর বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকি। ওই সময়ই আমি আমার স্বামীর বিষয়ে জানতে পারি সে একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। জানার পর আমার স্বামী আমাকেও তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা বলে। জঙ্গিবাদে তার কাজে সাহায্য করতে বলে। স্বামীর কথা শুনে আমিও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাই।

আসমা বলেন, আমি যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম সেটা আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। এটা স্বাভাবিক জীবন না। বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা-স্নেহ থেকে দূরে সরে এসে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতাম। ধর্মের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যে মানুষটি আমাকে জীবনসঙ্গী করে নিয়েছিল, সে মানুষটিও অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে থাকে।

‘সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। নিজেকে খুব অসহায় লাগতে শুরু করে। একপর্যায়ে আমি ওই পথ থেকে ফিরে আসতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেই। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আজ আত্মসমর্পণ করি। এটি সম্ভব হয়েছে র‌্যাবের সহযোগিতা কারণে।’

দেশের তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি অবশেষে বুঝতে পেরেছি, আমি ভুল পথে ছিলাম। আমি চাই না আমার মতো আর কেউ ভুল করুক। এ পথে পা না বাড়িয়ে সবাই যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। আমি আমার পলাতক স্বামীকেও ভুল পথ থেকে ফিরে আসার জন্য আহ্বান করছি। সবারই উচিত নিজের আত্মিক ও মানসিক পরিচর্যা করা। নিজের প্রতি নিজের  জাজমেন্ট থাকা। কোনো কিছু অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা।

মেয়েকে ফিরে পেয়ে আসমার মা শাহিদা সুলতানা বলেন, আজ আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমরা আসমাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালোবাসতাম। কিছুদিন আগে জানতে পারি আসমা যাকে পালিয়ে বিয়ে করেছে সে একজন জঙ্গি। সে তাকেও জঙ্গি বানিয়েছিল। একজন জঙ্গির মা হওয়া অনেক কষ্টের। আমি সব মা-বাবাকে অনুরোধ করবো, আপনারা আপনাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখুন, সময় দিন।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা মোহাম্মদ সাব্বির আহমেদ বলেন, যারা তওবা করে তাদের আল্লাহ তায়ালা অনেক পছন্দ করেন। আর যারা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদে জড়িত তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তি রয়েছে।

‘যারা জঙ্গি ও বোমা হামলা চালায় তারা একসঙ্গে তিনটা কবিরা গুনাহ করে। এক, তারা মানুষ হত্যা করে। দুই, সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। তিন, আত্মহূতি দিয়ে নিজেদের স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে ফেলে। কেননা আত্মহত্যার পরে তওবা করার আর কোন সুযোগ থাকে না।’

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। মানুষ হত্যাতো দূরের কথা, বিনা প্রয়োজনে কোনো প্রাণীকেও হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ বলে জানান এই আলেম।

সর্বশেষ সংবাদ

কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না নয়: আইজিপি

পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের করা মামলাসমূহ যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ