এক সপ্তাহের মাথায় ওভাল অফিসে চার বছরের মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ শাসনামলের পুরো সময় ধরেই তিনি বিশ্বব্যাপী অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরাচারী হিসেবে পরিচিত শাসকদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, চীনের শি জিনপিং, উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উন, মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি প্রমুখের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বরাবরই সচেষ্ট ভূমিকা রাখতে দেখা গিয়েছে ট্রাম্পকে। এদের মধ্যে কারো কারো সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বড় ধরনের বিরোধে জড়ালেও পরোক্ষভাবে তাদের নানাভাবে সহায়তা ও আনুকূল্য দেয়ার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের দেশী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগের চলমান তদন্তেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন ট্রাম্প। এর কারণ হিসেবে ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এসব নেতার কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে অতিকর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী আচরণের মাধ্যমে দেশ চালানো ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাবভঙ্গিমায় রীতিমতো মোহিত হয়ে পড়েছেন ট্রাম্প। ফলে তাদের ব্যক্তিগত অনুরোধও কখনো উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি।
অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণতা ও স্বৈরাচারের প্রতি ট্রাম্পের এ দুর্বল আচরণের বড় একটি উদাহরণ হয়ে রয়েছে তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হাল্কব্যাংক। অর্থনৈতিক অবরোধ লঙ্ঘন করে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে জড়ানোর অভিযোগে হাল্কব্যাংকের বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে মামলা চলছে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে হোয়াইট হাউজের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এতদিনেও খুব একটা এগোয়নি মামলাটি। দুজন তদন্তকারীকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি নিজ মন্ত্রিসভাকে দিয়ে এ মামলা প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন বিচার বিভাগকে রীতিমতো চাপে রেখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো চলমান রয়েছে মামলাটি। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রে হাল্কব্যাংকের বিদ্যমান সম্পদ ও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ জব্দ করা হতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কার্যক্রম পরিচালনা নিয়েও নানা বিধিনিষেধে পড়তে পারে ব্যাংকটি। সেক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে মন্দা ভাবে থাকা তুরস্কের অর্থনীতি আরো বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে পারেন এরদোগান।
অথচ আগের প্রশাসনের করা পরমাণু চুক্তি বাতিল করে তেহরানের ওপর শিথিলীকৃত অর্থনৈতিক অবরোধ আরো জোরদার করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। ইরান ও তুরস্ক ইস্যুতে হোয়াইট হাউজের এ পরস্পরবিরোধী আচরণের পেছনে ট্রাম্পের এরদোগানপ্রীতিকেই চিহ্নিত করেছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা জন বোল্টন বলেন, এখানে হাল্কব্যাংক বা ইরান আদতে কোনো বিষয়ই নয়। ট্রাম্প মূলত এখানে এরদোগানকেই সুরক্ষা দিতে চেয়েছেন। কারণ এরদোগানের মতো অতিকর্তৃত্ববাদী ও নিজেকে যাবতীয় জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া নেতাদের প্রতি সব সময়ই অতিরিক্ত মুগ্ধতা দেখিয়ে এসেছেন ট্রাম্প। তার বিদেশনীতিও বরাবরই এ ধরনের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
জন বোল্টনের ধারণা, শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও এরদোগানের মতো নেতাদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতা বা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাবভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনার বিষয়টি ট্রাম্পকে বেশ মোহিত করেছে।
সম্প্রতি বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ফরেন পলিসিতে করা এক মন্তব্যে ট্রাম্প প্রসঙ্গে এ মূল্যায়ন তুলে ধরেন জন বোল্টন। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে নানা জায়গায় আলোচনা করেছেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে তত্কালীন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পি বারের সঙ্গে এক আলাপে তুরস্ক ও চীনের কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রতি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আনুকূল্য প্রদর্শনের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বোল্টন। সে সময় উইলিয়াম পি বার কয়েকটি চীনা ও তুর্কি কোম্পানির বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগের চলমান তদন্তের কথা জানিয়ে বলেন, এসব তদন্ত স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক আবহ তৈরি করে রেখেছেন; যাতে মনে হচ্ছে অনেকটা অসমীচীনভাবেই এসব তদন্তে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে উইলিয়াম পি বার সে সময় শি জিনপিং ও এরদোগানের সঙ্গে ট্রাম্পের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনার কথাও তুলে ধরেন। এর মধ্যে চীনা টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান জিটিই নিয়ে ট্রাম্প-জিনপিংয়ের আলোচনার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে উত্তর কোরিয়া, ইরান ও অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি স্বীকার করে ২০১৭ সালে বিপুল অংকের অর্থ জরিমানাও পরিশোধ করে কোম্পানিটি। এর এক বছরের মাথায় উপদেষ্টা ও রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের আপত্তির তোয়াক্কা না করে জিটিইর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০১৮ সালে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আলোচনার টেবিলে বসে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনকে নিয়ে জনসম্মুখে রীতিমতো প্রশস্তি গাইতে দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ওই আলোচনা ভেস্তে গেলেও পরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, তার ও কিম জং উনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাধেনি।
ইস্তাম্বুলে সাংবাদিক জামাল খাসোগির নৃশংস হত্যার ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল মার্কিন কংগ্রেস। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে বিষয়টি বেশিদূর গড়ায়নি। এ বিষয়ে ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, আমিই তাকে রক্ষা করেছি। আমি তাকে তার মতো ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কংগ্রেসকে রাজি করাতে পেরেছি। আমি শেষ পর্যন্ত তাদের থামাতে পেরেছি।
অন্যদিকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের তেমন উন্নয়ন না হলেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বরাবরই বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ট্রাম্পের। এমনকি ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো অভিসংশনের মুখে পড়েন, তখন বিশ্বনেতাদের মধ্যে একমাত্র পুতিনই তাকে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা ট্রাম্পকে বরাবরই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পুতিন কোনোভাবেই তার বন্ধু হতে পারেন না। তবে এসব বক্তব্যের প্রভাব যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওপর তেমন একটা পড়েনি, সে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন তারাও।
ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পুরো সময়েই ট্রাম্পকে স্বৈরাচারী নেতাদের প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছে। ২০১৯ সালেও মিসর সফরে গিয়ে সেখানকার প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠকের আগে অপেক্ষারত অবস্থায় তাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘কোথায়? আমার প্রিয় স্বৈরাচারী নেতা কোথায়?’
এছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন বা লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো স্বৈরাচারী নেতাদেরও প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প।