করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে নতুন বছর উদযাপনের উৎসব-আনন্দে। সম্প্রতি ভাইরাসের নতুন ধরন বিস্তার লাভ করায় ইউরোপজুড়ে আগের চেয়েও বেশি কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে ।
সন্ধ্যার পর নববর্ষের অনুষ্ঠান পণ্ড করতে এবং রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করতে ফ্রান্সে এক লাখ পুলিশকে দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছিল।
গত বছর করোনাভাইরাস মহামারিটি শুরুর পর থেকে বিশ্বজুড়ে ৮.১ মিলিয়নেরও বেশি লোক মারা গেছে এবং এ পর্যন্ত ৮১ মিলিয়নের বেশি ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে।
ইউরোপজুড়ে যা হচ্ছে
ফ্রান্সে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই কারফিউ জারি করা হয়। প্যারিসে অর্ধেকেরও বেশি মেট্রো লাইন বন্ধ ছিল।
বছরের শেষ রাতে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আতশবাজি এবং অ্যালকোহল বিক্রি সীমিত করে দেওয়া হয়। সহিংসতার তেমন কোনো ঘটনা শোনা যায়নি; তবে কিছু জায়গায় পুলিশের ওপর হামলার রিপোর্ট করা হয়েছে! এছাড়া আলসেস প্রদেশে একজন (২৫) বাজি পোড়াতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন।
ফ্রান্সে ইতোমধ্যে দুটি লকডাউন দেওয়া হয়েছে; বার, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ নতুন বছরেও সীমিতই থাকবে।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তায়, প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ ফ্রান্সে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বিলম্বিত সরবরাহের কথা উল্লেখ করে জানান, ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ফ্রান্সে কোনোরকম ‘অযৌক্তিক বিলম্ব’ হবে না।
এদিকে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত; ৪০ মিলিয়নেরও বেশি লোককে ঘরে থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জনগণকে ঘরে থাকার এবং নিয়ম অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
পুলিশের সতর্কতার পরে লন্ডনের রাস্তাগুলো ফাঁকাই পড়ে ছিল বছরের শেষ সন্ধ্যায়। ‘লন্ডন আই’য়ের পরিবর্তে অবশ্য রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে আতশবাজি, পটকা এবং আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
আয়ারল্যান্ডে বৃহস্পতিবারে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ কঠোরতা আরোপ করা হয়। কারও বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনের বাইরে কেনাকাটা করা এবং পাঁচ কিলোমিটারের বাইরে ভ্রমণ- সবকিছুই ছিল নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত।
জার্মানিতে আগে থেকেই লকডাউন কার্যকর হয়ে আছে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। আতশবাজি বিক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা ইউরোপের এই দেশেও বহাল।
ইতালির অবস্থাও ফ্রান্সের মতোই। বার, খাবারের দোকান, শপিংমল সবকিছু বন্ধ। কোমরের পুরনো ব্যথার জন্যে পোপ ফ্রান্সিস এদিকে নিউ ইয়ার ইভ এবং নিউ ইয়ার ডে- রোমের কোনো অনুষ্ঠানেরই পরিচালনা করছেন না। নেদারল্যান্ডসের লকডাউন বহাল ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। আমস্টারডামের এক ফুটবল স্টেডিয়ামে ক্ষণ গণনার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়েছে ইউরোপের এই দেশে; যদিও মানুষের অংশগ্রহণ ছিল তাদের নিজ নিজ গৃহ থেকেই!
তুরস্ক নতুন করে চারদিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নববর্ষ বরণ
বেশিরভাগ প্রদেশ এবং নগরেই উদযাপনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত ছিল। নিউইয়র্কে হাতে গোণা কিছু মানুষকেই টাইমস স্কয়ারের বিখ্যাত ‘মিডনাইট বল ড্রপ’ উপভোগের সুযোগ দেওয়া ছিল: মূলত সম্মুখসারির যোদ্ধারা তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দের সাথে এ বছর এই বিশেষ উদযাপন চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
তারকারা বরাবরের মতোই টেলিভিশনের বিভিন্ন পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছেন। লাস ভেগাস, সান ফ্রান্সিসকোর মতো শহরগুলোতেও আতশবাজি পোড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে করা টুইটে এত দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করাকে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়’ বলে অভিবাদন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহকারী উদ্যোগ ‘অপারেশন ওয়ার্প স্পিড’কে সম্মান দেওয়া হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে তিন লাখের ওপরে করোনায় মৃত মানুষদের স্মরণ করতে বোধহয় প্রেসিডেন্ট ভুলে গেছেন তার এই টুইটে।
এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোতে প্রভাব
নববর্ষের একেবারে প্রথম প্রহরে যেসব দেশে নতুন বছরের দামামা বাজানো হলো তাদের ভেতরে অস্ট্রেলিয়া প্রথম সারিতেই। সিডনির আতশবাজি এবং আলোকসজ্জা বহুদূর পর্যন্ত চোখ ধাঁধিয়ে রাখলেও তা উপভোগের জন্য নগর-বন্দরে জমায়েতের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার গ্ল্যাডিস বেরেযিকলিয়ান বলেন, “নববর্ষের প্রাক্কালে আমরা এমন কোনো আয়োজন রাখতে চাইনি যা ভাইরাসের বিস্তার ছড়াতে সাহায্য করবে।”
সিডনির অনেক বাসিন্দা বাড়িতে বসে টিভির পর্দাতেই আতশবাজি পোড়ানোর দৃশ্য উপভোগ করেছেন; কেননা পাঁচজনের বেশি গণজমায়েত নিষিদ্ধ ছিল।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে নববর্ষের লাইট শো’র আয়োজনও এবার রাখা হয়নি।
পুরো দেশজুড়ে উদযাপন সীমিত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেখান থেকে করোনাভাইরাসের উত্থান ধরে বলে নেওয়া হয়, সেই উহানেই, সিটি সেন্টারে হাজারো মানুষ নববর্ষের আনন্দ ভাগাভাগি করতে একসাথে জড়ো হয়!
জাপানে নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। রীতি অনুযায়ী এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর সম্রাট নারুহিতো এবং রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ মানুষের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে থাকেন।
ভারতে, দিল্লি এবং অন্যান্য শহরে সান্ধ্য কারফিউ জারি করা হয়; গণজমায়েত রহিত করতে নেওয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ।
অন্যদিকে, নিউজিল্যাণ্ডে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে প্রতিবছরের মতোই। কঠোর লকডাউন এবং সীমান্ত বন্ধ করে রাখার মতো পদক্ষেপের পর এ দেশে করোনার বিস্তার ছিল নিয়ন্ত্রিত।
সূত্র: বিবিসি