স্পুটনিক-৫: ভ্যাকসিন বাজিতে জিতে গেলেন পুতিন

অবশ্যই পরুন

গত বছরের আগস্টে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দেয় রাশিয়া। এত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন অনুমোদনের বিষয়টি হতবাক করে তোলে বিশ্বের অনেককেই। ডিসেম্বরে দেশটির স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতের ফ্রন্টলাইনার কর্মীদের ওপর স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়। তৃতীয় পর্যায়ে বৃহদায়তনের পরীক্ষা চালানোর আগেই বিশ্বে কভিড-১৯-এর প্রথম প্রয়োগের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেয়নি কেউই। সে সময় বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতের অনেকেই রাশিয়ার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের খামখেয়ালিপনার ফসল হিসেবে। অভিযোগ তোলা হয়, ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যাপ্ত মাত্রায় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ না করেই ভ্যাকসিনের অনুমোদন ও প্রয়োগের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য নিয়ে জুয়া খেলছেন পুতিন। তবে চলতি সপ্তাহে ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল বলছে, পুতিন শেষ পর্যন্ত তার বাজি জিতে নিয়েছেন। ট্রায়ালে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। সে হিসাবে পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের তুলনায় এটি কোনো অংশেই কম না, বরং কিছু কিছু ভ্যাকসিনের চেয়ে এটি বেশি কার্যকর।

যেকোনো ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের উদ্দেশ্য হলো এর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুঁজে বের করা। প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ের এ ট্রায়ালে অন্তত কয়েক হাজার মানুষের ওপর গণহারে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করার নিয়ম রয়েছে। তবে রাশিয়া যখন স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়, ততদিনে এটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে মাত্র ৩৮ জনের ওপর। ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের পর তাদের প্রত্যেকের দেহেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও মাথাব্যথা ছাড়া কারো মধ্যে এর অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। তবে অনুমোদনের আগে স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরীক্ষামূলক এ প্রয়োগের ফলাফল মূল্যায়নও (পিয়ার রিভিউ) করা হয়নি।

ভ্যাকসিন নিয়ে তাড়াহুড়োর বিষয়টিকে সে সময় পুতিনের জনস্বাস্থ্য নিয়ে জুয়া খেলার নামান্তর অভিহিত করে এ নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল অনেকেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি ছিল, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ  ও কার্যকর কিনা, তা নির্ধারণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কেউ কেউ আবার মতামতও দিয়েছিল, শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই ভ্যাকসিনটি নিয়ে এ হঠকারী পদক্ষেপ নিয়েছে মস্কো।

কিন্তু পুতিনের এ ‘ভ্যাকসিন হঠকারিতাকেই’ এখন ইতিবাচক চোখে দেখছেন আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে কভিড-১৯ প্রতিরোধে এর কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ।

স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিন উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (আরডিআইএফ)। প্রতিষ্ঠানটির সিইও কিরিল দিমিত্রিয়েভ সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমি মনে করি এখানে সবকিছুই অত্যন্ত সূচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এবং একদিক থেকে এখন নতুন এক নজির তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব লিস্টারের কনসালট্যান্ট ভাইরোলজিস্ট ড. জুলিয়ান তাংয়ের মতে, ভ্যাকসিন নিয়ে রাশিয়ার এ ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতির প্রয়োগ এখন পর্যন্ত কিছু মাত্রায় ন্যায্য বলেই প্রমাণ হয়েছে।

স্পুটনিক-৫ প্রয়োগ করা হয় দুই ডোজে। মস্কোভিত্তিক গামালেয়া ইনস্টিটিউট ও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছরের ১১ আগস্ট জানান, মস্কোর স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ভিত্তিতে নতুন একটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে।

ওই সময়ে এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জোর গলায় বক্তব্য দিতে থাকেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও গবেষণা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা। কোনো কোনো ভাইরাস বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ের ট্রায়াল দুটিতে বড় মাত্রার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গবেষকদের নজর এড়িয়ে গেলে তা জনমনে অন্যান্য ভ্যাকসিন নিয়েও দ্বিধা ও অবিশ্বাসের জন্ম দেবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকে সায়েন্স মেডিসিন সেন্টারের এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটির জিন বিশেষজ্ঞ ফ্রাঁসোয়া ব্যালু বলেন, এটি পুরোপুরি একটি হঠকারী ও নির্বোধ সিদ্ধান্ত। ভালোভাবে পরীক্ষা না চালিয়ে গণহারে টিকা প্রয়োগের বিষয়টি অনৈতিকও বটে। রাশিয়ার টিকা প্রয়োগ কর্মসূচিতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাবে ফেলার পাশাপাশি জনমনে ভ্যাকসিনের গ্রহণযোগ্যতাকে আরো কমিয়ে দেবে।

এসব সমালোচনায় কর্ণপাত না করে আগস্টেই বৃহদায়তনে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করে রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বরের মধ্যেই শিক্ষক ও চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করে। এর কারণ বলতে গিয়ে আরডিআইএফের সিইও কিরিল দিমিত্রিয়েভ বলেন, আমরা জানতাম মানবদেহে টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত অ্যাডেনোভাইরাল প্লাটফর্ম এ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ব্যবহার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অপরীক্ষিত মেসেঞ্জার আরএনএ প্লাটফর্মনির্ভর ভ্যাকসিনের তুলনায় এটি পুরোপুরি ভিন্ন। এ কারণে আমরা এখন যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, শুধু তাদের চাহিদার ভিত্তিতেই এটির প্রয়োগ করে যাচ্ছি।

তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৯২ শতাংশ বলে ঘোষণা দেয় রাশিয়া। তবে এ ফলাফলের উৎস ছিল মাত্র ২০ জনের ওপর প্রয়োগ করে পাওয়া তথ্য। এছাড়া এ নিয়ে কোনো পিয়ার রিভিউ ছিল না। অন্যদিকে ভ্যাকসিন নিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালানো হয় স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিন গ্রহণ করা প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তির ওপর। তাদের মধ্যে প্রথম ডোজ গ্রহণের ২১ দিনের মধ্যে কভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন মাত্র ১৬ জন। মৃদু বা মারাত্মক লক্ষণ দেখা যায়নি কারো মধ্যেই।

তবে করোনার লক্ষণহীন সংক্রমণ প্রতিরোধে স্পুটনিক-৫ কতটা কার্যকর, সে বিষয়ে গবেষকদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের সংক্রমণবিষয়ক তথ্য গবেষকদের কাছে অনুপস্থিত।

এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬টি দেশে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দেশগুলো হলো বেলারুশ, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, সার্বিয়া, আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন, ভেনেজুয়েলা, প্যারাগুয়ে, তুর্কমেনিস্তান, হাঙ্গেরি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, গিনি ও তিউনিসিয়া।

কিরিল দিমিত্রিয়েভ জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ ভ্যাকসিনটিতে অনুমোদন দেয়া দেশের সংখ্যা ২৫-এ পৌঁছবে। তবে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এ মুহূর্তে ভ্যাকসিনটির প্রয়োগ অনুমোদনের জন্য আবেদন করার কথা ভাবা হচ্ছে না।

বিজনেস ইনসাইডার অবলম্বনে

সর্বশেষ সংবাদ

রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তনেও সঙ্গে থাকার বার্তা জাপানের

রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান কাজ চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি। রোববার (২৪...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ