spot_img

ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও সংক্রমণের সম্ভাবনা কি মহামারির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ?

অবশ্যই পরুন

কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অর্থাৎ, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর তীব্র জ্বরের কবলে পড়েন দিল্লির পল্লব বাগলা। জ্বর ছাড়াও শারীরিক অস্বস্তিসহ গলাব্যথায় ভুগতে থাকেন পল্লব। পেশায় সাংবাদিক পল্লবের পরীক্ষা করানোর পর করোনা শনাক্ত হয়। চারদিন পর তিনি সিটি স্ক্যান করান। ততদিনে ফুসফুসেও সংক্রমণ ছড়িয়ে গেছে।

জ্বর না কমায় প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দেওয়ার আটদিন পর হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৮ বছর বয়সী পল্লব।

অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকাল সায়েন্সেস হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত স্টেরয়েডের মাধ্যমে চিকিৎসা দেন। পল্লবের ডায়াবেটিস থাকায় রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তবে, সৌভাগ্যজনকভাবে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক ছিল।

আটদিন পর হাসপাতাল থেকে তিনি ছাড়া পান। চিকিৎসকরা পল্লবকে তারই বয়সী ডায়াবেটিস আক্রান্ত একজন কোভিড আক্রান্ত পুরুষ রোগীর ফুসফুসের স্ক্যানচিত্র দেখান। পার্থক্য এই যে, নতুন এই রোগী কোনো টিকা গ্রহণ করেননি।

“পার্থক্য ছিল খুব স্পষ্ট। ডাক্তাররা আমাকে বলেন আমি যদি ভ্যাকসিন না নিতাম, তাহলে হয়তো ভেন্টিলেটর বা নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ত। সময়মতো পূর্ণাঙ্গ ভ্যাকসিন গ্রহণ করায় আমি বেঁচে আছি,” বলেন পল্লব বাগলা।

১৩০ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ভারত মাত্র ৩ শতাংশ জনগণকে পূর্ণাঙ্গভাবে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে, দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণের দুই সপ্তাহ পরেও অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। দিন দিন এই হার বাড়ছে।

এখন পর্যন্ত এ ধরনের সংক্রমণে সবথেকে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন চিকিৎসক, নার্স এবং হাসপাতাল কর্মীসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মীরা। পল্লব বাগলার কেসটি ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ায় তাকে আক্রান্ত করা ভাইরাস শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরা তার নাক এবং গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন।

বিজ্ঞানীরা সবথেকে বেশি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন তা হল- বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলো কি করোনাভাইরাসের অধিক সংক্রামক নতুন প্রকরণ থেকে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট?

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলো নিঃসন্দেহে কার্যকরী। তারা ভাইরাসের ভয়ংকর সব প্রকরণের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারলেও গুরুতর অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম।

সুতরাং, “ভ্যাকসিন দিয়েও সংক্রমিত” হওয়ার বিষয়টি অপ্রত্যাশিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্যানুসারে, পূর্ণাঙ্গভাবে টিকাগ্রহণকারী ৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে গত ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে নয় হাজার ৪৫ জন করোনায় আক্রান্ত হন।

আক্রান্তদের মধ্যে ৯ শতাংশ অর্থাৎ, ৮৩৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। মারা যায় মাত্র এক শতাংশ বা ১৩২ জন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশ এবং মৃতদের ১৫ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ ‘উপসর্গবিহীন বা কোভিড-১৯ সম্পর্কিত নয়’ বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।

দুর্বল তথ্য-উপাত্তের কারণে ভারতে এই সংক্রান্ত প্রমাণাদি অপর্যাপ্ত।

বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী পূর্ণাঙ্গ দুই ডোজ টিকা গ্রহণের পরও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এছাড়া কয়েকজন মৃত্যুবরণও করেছেন। তবে, মৃত্যুর জন্য সরাসরি কোভিড সংক্রমণই দায়ী কি না বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।

দাপ্তরিক তথ্যানুসারে, ভারতে টিকাগ্রহণকারী প্রতি ১০ হাজার মানুষের মাঝে দুই থেকে চারজন ভ্যাকসিন গ্রহণ করা সত্ত্বেও সংক্রমিত হয়েছেন। তবে এই তথ্য পূর্ণাঙ্গ নয়। গত তিন মাস ধরে যারা পরীক্ষা করাচ্ছেন তাদের কাউকেই টিকা গ্রহণ সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করা হয়নি।

হাসপাতালগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যও মিশ্র।

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকের অধ্যাপক ডাক্তার ভিনসেন্ট রাজকুমার জানান, তিনি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের তামিল নাড়ুতে রাষ্ট্রচালিত বড় দুটি হাসপাতালের সাথে কথা বলেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের টিকাগ্রহণকারী কর্মীদের খুব “সামান্য অংশ” সংক্রমিত হয়েছেন। “খুব সামান্য সংখ্যক যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তারাও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন,” বলেন তিনি।

নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ফারাহ হুসাইন জানান, দিল্লির বৃহত্তর কোভিড-১৯ হাসপাতাল লোক নায়ক জয় প্রকাশ নারায়ণ (এলএনজেপি) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগের ৬০ শতাংশ চিকিৎসক পূর্ণাঙ্গ দুই ডোজ টিকা গ্রহণের পরও সংক্রমিত হন। তাদের কাউকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। তবে, পরবর্তীতে তাদের পরিবারের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ফর্টিস সি-ডক নামের দিল্লির অপর এক হাসপাতালে ১১৩ জন ভ্যাকসিন গ্রহণকারী স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে ১৫ জনের দেহে দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর করোনা শনাক্ত হয়। ১৪ জনই মৃদু সংক্রমণে ভুগেন। কেবলমাত্র একজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

“টিকাগ্রহণের পরও আমরা অসংখ্য স্বাস্থ্যকর্মীকে সংক্রমিত হতে দেখছি। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশের সংক্রমণ ছিল মৃদু। গুরুতর সংক্রমণকে প্রতিরোধ করছে ভ্যাকসিন,” বলেন ডায়াবেটোলজিস্ট এবং গবেষক ডাক্তার অনূপ মিসরা।

কেরালায় পূর্ণাঙ্গ টিকাগ্রহণের পর আক্রান্ত ছয় স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে নমুনা সংগৃহীত হয়। গবেষণার কাজে এই নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়।

আক্রান্তদের মধ্যে দুইজনের দেহে অভিযোজিত প্রকরণ পাওয়া যায় যা তাদের দেহে বিদ্যমান সুরক্ষা ব্যবস্থাকে অতিক্রম করেছিল। তবে কোনো সংক্রমণই মারাত্মক রূপ ধারণ করেনি বলে জানান গবেষণা সহযোগী এবং শীর্ষ জিন বিশেষজ্ঞ ডক্টর বিনোদ স্ক্যারিয়া।

ভারতের তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করছেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণ মানুষের মাঝে এ ধরনের সংক্রমণের বিস্তার পর্যালোচনার পাশাপাশি ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করছে সে বিষয়ে বিশদভাবে জানতে পর্যাপ্ত তথ্য প্রয়োজন।

ভাইরোলজিস্ট শহীদ জামিল বলেন, “মানুষ এখন বারবার যে প্রশ্নটি করছে তা হলো ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও টিকাগ্রহীতারা পুনঃসংক্রমিত হচ্ছে কি না।”

তিনি আরও জানান, “নির্ভরতাহীন প্রতিবেদনের কারণে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী মানুষের মাঝে দ্বিধার সৃষ্টি হয়।”

তবে, সবথেকে বড় উদ্বেগের বিষয়টি হলো ভারতের দৈনিক টিকাদান কার্যক্রম ক্রমশ কমছে। গোষ্ঠীভিত্তিক অনাক্রম্যতা বা হার্ড ইম্যুনিটি অর্জনও এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভ্যাকসিন নিতে অনাগ্রহের সৃষ্টি হলে বিষয়টি ভয়াবহ রূপ নিবে।

বিজ্ঞানীরা আরও জানান, ভারতের প্রাণঘাতী ও নিয়ন্ত্রণহীন এই দ্বিতীয় ঢেউ ভাইরাসের অভিযোজনের পক্ষে অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করবে। ফলে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার বাইরে গিয়ে আরও অধিক সংক্রামক প্রকরণের উদ্ভব হবে।

ভাইরাসের অভিযোজন বিশ্লেষণই হবে ভবিষ্যতের সংক্রমণ ঢেউ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।

বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী মূল কথা হল- বিভিন্ন মাত্রার কার্যকারিতা নিয়ে ভ্যাকসিনগুলো গুরুতর সংক্রমণ এবং হাসপাতালমুখো হওয়া থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।

কিন্তু, পূর্ণাঙ্গভাবে ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও যেহেতু নিজে সংক্রমিত হওয়া এবং অন্যদের সংক্রমিত করার সম্ভাবনা থাকে, তাই সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো সমঝোতা করা চলবে না। আরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত মাস্ক পরিধানসহ ভিড় ও সামাজিক জমায়েত এড়িয়ে চলার পাশাপাশি বদ্ধ ও এয়ার কন্ডিশনযুক্ত কর্মক্ষেত্র পরিহার করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ ভারতের কেরালা রাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। কেরালায় দুটি মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক। জনস্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বার্তাগুলোও বিভ্রান্তিকর না হয়ে যেন স্পষ্ট ধারণা দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন, কেউ যদি পূর্ণাঙ্গভাবে টিকাগ্রহণ করেন, তাহলে কি তিনি ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন?

ভুক্তভোগী পল্লব বাগলা এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেন। তিনি বলেন, “ভ্যাকসিন কাজ করে। কিন্তু তারা আপনাকে বেপরোয়া চলাফেরা বা সুরক্ষা ব্যবস্থা বাদ দেওয়ার অনুমতি দেয় না। আপনাকে অবশ্যই খুব সতর্ক থাকতে হবে।”

বিবিসি অবলম্বনে 

সর্বশেষ সংবাদ

কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না নয়: আইজিপি

পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের করা মামলাসমূহ যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ