spot_img

“ট্রাম্প আসলে নিজেই নিজেকে অভিশংসিত করেছেন”

অবশ্যই পরুন

টানা দুইবার প্রতিনিধি পরিষদ অভিশংসিত একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্টে পরিণত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ, ২৫০ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে হওয়া অর্ধেক অভিশংসনের দাবিদার তিনি। রিপাবলিকান দলের মাত্র ১০ জন কংগ্রেস সদস্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটদের সঙ্গে যোগ দেন, কিন্তু নিজ দলের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দেওয়া এটাই সর্বোচ্চ ভোটের রেকর্ড।

পরিষদে সংখ্যালঘু রিপাবলিকান দলের নেতা কেভিন ম্যাককার্থি এর আগে ট্রাম্পের সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তার চাইতেও লজ্জাজনক ছিল দলের এত সংখ্যক কংগ্রেস সদস্যের প্রেসিডেন্টের প্রতি আস্থা হারানো। অভিশংসনের পক্ষে ভোট না দেওয়া অপর তিন রিপাবলিকান এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ট্রাম্পের “কথা ও কাজের” নিন্দা করেছেন। তবে ট্রাম্পের সমর্থনেও অনেকে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এনিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে বক্তব্য দেননি। যারা দিয়েছেন, তাদের যুক্তিও ছিল ভাসাভাসা, অসম্পূর্ণ। বেশিরভাগই ট্রাম্পকে বাদ দিয়ে কথা বলেছেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে।

কিন্তু, কেন এমনটা হলো? ট্রাম্পের পক্ষেই তো জোর যুক্তিতর্ক চলতে পারতো। কারণ, অধিকাংশ রিপাবলিকান রাজনীতিক ও ট্রাম্প সমর্থকরা মনে করেন; ট্রাম্পের বর্তমান মেয়াদে যা কিছু কেলেঙ্কারি হয়েছে, তিনি শুধু সেখানে এক নিরাপরাধ-নিস্পাপ পর্যবেক্ষক ছিলেন। তিনি অপরাধী নন বরং বিপরীত ঘটনা প্রবাহের ভিকটিম। তাই ট্রাম্প নির্বাচনে জালিয়াতি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন, তাকেও সমর্থন জানায় সিংহভাগ রিপাবলিকান। তাদের দাবি অনুসারে, শুধু অকাট ঘৃণা আর বিদ্বেষ থেকেই ডেমোক্রেটরা ট্রাম্পকে অভিশংসিত করেছে। এই দাবির পেছনে তারা ২০১৯ সালের ইমপিচমেন্টকে যুক্তি হিসাবে দেখায়। তাদের মতে, যেহেতু ডেমোক্রেটরা প্রাণপণে ট্রাম্পকে হঠাতে চায় সেজন্যেই এ প্রচেষ্টা অবৈধ। সোজা কথায়, প্রেসিডেন্ট নিজ অপরাধে নয়, বরং হয়েছেন ডেমোক্রেটদের ঘৃণার বলি।

যুক্তিটি কাণ্ডজ্ঞানহীন, উম্মাদের সংলাপ। ডেমোক্রেটরা ইতোপূর্বে দুই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও জর্জ ডব্লিউ. বুশের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল। তাদের প্রতি তীব্র আক্রোশ থাকা সত্ত্বেও ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত হাউজ (প্রতিনিধি পরিষদ) কখনও তাদের অভিশংসনের উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি এসব রাষ্ট্রপতির নানা কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাওয়ার পরও নয়।

তাহলে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কেন তার ব্যত্যয়? ব্যাখ্যা হচ্ছে; বেশিরভাগটাই আইনের প্রতি ট্রাম্পের অশ্রদ্ধার কারণে। দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই মার্কিন সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছেন তিনি। ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথমদিন থেকেই যার শুরু। সেসময় তিনি সংবিধানের আর্থিক বিধানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিদেশি কর্মকর্তাদের তার মালিকানাধীন ওয়াশিংটন হোটেল এবং অন্যান্য আবাসিক অতিথিশালায় থাকতে দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হন। এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ অনুসন্ধানের তদন্ত শুরু করায় তৎকালীন এফবিআই প্রধানকে বরখাস্ত করেন। এটা ছিল তার ন্যায়বিচারে বাধা দেওয়ার প্রথম উদ্যোগ।

পরবর্তীকালে মার্কিন বিচার বিভাগের বিশেষ কাউন্সাল রবার্ট মুল্যারের তদন্তে ট্রাম্পের নির্বাচনী জালিয়াতি নিয়ে মিথ্যে বক্তব্যের অসারতা এবং বিচারে বাধা সৃষ্টির বিবরণ উঠে আসে। মুল্যার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালে জয়ের পর থেকেই ট্রাম্প বিদেশি শক্তির সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে নির্ভেজাল মিথ্যে দাবি করেছেন। এমনকি দায়িত্বশীল তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের হয়ে কাজ করা, রাজনৈতিক শত্রুতার মতো অভিযোগও আনেন তিনি। ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর সমাপ্ত নির্বাচনে হেরে তিনি আর একবার মিথ্যের বেসাতি খুলে বসেন। প্রচার করতে থাকেন, জালিয়াতির কারণেই এ পরাজয়। এমনকি নিজের পক্ষে ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি রাজ্যের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী জালিয়াতি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন।

তবে শুধু আইন লঙ্ঘনের কারণেই ডেমোক্রেটরা অভিশংসনের উদ্যোগ নেন এবং কিছু রিপাবলিকান তাতে সমর্থন দিয়েছেন বলে আমি মনে করি না। তাদের কেউ কেউ যোগ না দিলেও নিন্দা জানিয়েছেন। এমনকি প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন হোয়াইট হাউজের বেশ কয়েক জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। সাবেক প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ট্রাম্পকে ওভাল অফিস থেকে হঠানোর দাবি তুলেছেন। এই দাবির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন আবার রিপাবলিকান দলের সাবেক নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধি। সোজা কথায়; ট্রাম্প মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রায় সকলের কাছে অচেনা আতঙ্কে রূপ নিয়েছেন। অর্ধ-শতাব্দী আগে এমন বৈরিতা রিচার্ড নিক্সনও তৈরি করেন। এরপর অভিশংসন ঘনিয়ে আসছিল দেখে তিনি পদত্যাগ করেন।

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী নেলসন ডব্লিউ. পোলসবি নিক্সনের ব্যাপারে কয়েক যুগ আগে বলেন:

“নিক্সনের দৃষ্টিতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি শুধু বিশাল বৈধ ক্ষমতাই পাননি, বরং পদ মর্যাদা গুণে পেয়েছেন রাজনীতিক নেতা, সাংবাদিক, আমলা, ব্যবসায়ী এবং নানা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জোটের সঙ্গে অবৈধ কারবারের অন্যায্য ক্ষমতা। ওয়াশিংটনে এসব ব্যক্তির সঙ্গে তার দৈনিক রাষ্ট্রীয় কাজের ফাঁকে ব্যক্তিউদ্দেশ্য চরিতার্থ করাকে তিনি অপরাধ মনে করতেন না। গোপন এই মিত্রদের কল্যাণেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কুখ্যাতি লাভ করেন নিক্সন। কুখ্যাতি হলো এমন এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যাকে মানুষ হুমকি বলেই গণ্য করে। নিক্সনের নীতি রাজনৈতিক বৈধতার গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে অন্যান্য প্রভাবশালী রাজনীতিককে সঙ্গে করে একটি কালো মহীরুহে রূপ নেয়।”

সরলভাবে বলা যায়; সংবিধান দ্বারা পরিচালিত বৈধ সরকার নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প আর নিক্সন দুজনেই স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করেছেন।

গত ৩ নভেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত করা নিজ কীর্তিকালাপেই দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হয়েছেন ট্রাম্প। কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য তাকে মনে করেন জাতির জন্য হুমকি। তিনি কখনোই নিজেকে ভুল সামলে ওঠার সক্ষম করেননি। ডেমোক্রেটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ তার মধ্যে ছিল না। রিপাবলিকান দলেও শীর্ষ পর্যায়ের কিছু প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার সম্পর্ক। অতি-সংরক্ষণবাদি কট্টরপন্থী রাজনৈতিক নীতির জন্যে বেশিরভাগ রিপাবলিকান তাকে ছাড় দিতে ইচ্ছুক। তাছাড়া, ট্রাম্পের বিরোধিতায় নামলে দলে বিভাজন দেখা দেবে এবং তার কারণে নির্বাচনী অবস্থান দুর্বল হবে, সেই ভয় তো আছেই। আরও উগ্ররা সংবিধানের উদারপন্থী ধারাগুলো ছিঁড়ে ফেলতে ট্রাম্পের মতোই সমান উৎসাহী। তারা ট্রাম্পকে সেই বিপ্লব আর বিশৃঙ্খলার বরপুত্র হিসেবেই দেখেন। সেই সূত্রেই ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের আত্মিক সংযোগ। কিন্তু, মিত্রতার ব্যবহারিক সম্পর্ক ট্রাম্পের তেমন নেই। নিক্সনের অন্তত সেটা ছিল।

এই নির্বাচনী স্বার্থ এবং দলীয় মতপার্থক্যের রাজনীতিতে আরও একবার সিনেট ট্রায়ালে নিষ্কৃতি পেতে পারেন ট্রাম্প। একারণেই, হয়তো তিনি স্বপদে থেকেই মেয়াদ শেষ করবেন। অর্থাৎ, তাকে কেন্দ্রীয় আইনে অভিযুক্ত প্রমাণিত হয়ে দপ্তর ছাড়তে হবে না। কিন্তু, ধোঁয়াশা তখনই স্পষ্ট হবে, যখন আগামী ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। কিন্তু, চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিত্র আর বন্ধু ছাড়াই হোয়াইট হাউজ ছাড়বেন ট্রাম্প। আর যতদিন আছেন ততদিন অনেক কর্মকর্তা সরাসরি তার নির্দেশ অবজ্ঞা বা অমান্য করবেন। তিনি ইতিহাসে এক দুর্বল-অরাজক নেতা হিসেবেই ঠাঁই পাবেন।

লেখক: রাজনীতি এবং প্রশাসনিক নীতি নিয়ে ব্লুমবার্গের একজন মতামত কলাম লেখক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এবং ডিপউ ইউনিভার্সিটিতে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। 

সর্বশেষ সংবাদ

কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না নয়: আইজিপি

পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের করা মামলাসমূহ যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ