এমন কিছু নফল নামাজ আছে, যা পড়লে উভয় জাহানে ব্যাপক কল্যাণ সাধন হয়। এসব নফল নামাজ পাঁচ ওয়াক্তে পড়তে হয়। এগুলো হচ্ছে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, জাওয়াল ও আউওয়াবিন।
তাহাজ্জুদ
আরবি ‘তাহাজ্জুদ’ শব্দের অর্থ হলো নিশীথে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। রাতের দ্বিতীয় প্রহরের পর ঘুম থেকে জেগে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে নামাজ আদায় করা হয়, তা-ই তাহাজ্জুদ নামাজ। ফকিহগণ বলেন, এশার নামাজ শেষে ঘুমানোর পর আবার জেগে এই নামাজ পড়তে হয়। কেউ কেউ ‘জুহদ’ শব্দের সঙ্গে ‘তাহাজ্জুদ’-এর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করেন; যার অর্থ হলো শক্তি ও ক্লেশ। কারণ, এই নামাজে কষ্ট-ক্লেশ হয় এবং এর জন্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয় বা এর দ্বারা আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ হয়।
মধ্যরাতের পরে বা রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়। ঘড়ির ঘণ্টা হিসেবে রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার (সূর্যোদয়ের দেড় ঘণ্টা) আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত। রমজান মাসে সেহ্রির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জামানায় তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য আলাদা আজান দেওয়া হতো। এখনো মক্কা ও মদিনা শরিফে এ নিয়ম প্রচলিত আছে। নফল ইবাদত বিশেষ উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ছাড়া গোপনে করাই বাঞ্ছনীয়। তবে ‘তাহাজ্জুদ নামাজ অন্ধকারে পড়তে হয়’ বা ‘তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে জিন আসে’ অথবা ‘তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়’—এসব ভুল ধারণা। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচারের মানসিকতা যেন না থাকে; এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে।
নবীজি (সা.) সব সময় তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে (মাকামে মাহমুদে)।’ (১৭: ৭৯)। তাহাজ্জুদ নামাজ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য ছিল। এর রাকাত সংখ্যা ৮, ১২ থেকে ২০ পর্যন্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। চার রাকাত বা দুই রাকাত পড়লেও তা তাহাজ্জুদ হিসেবে পরিগণিত হবে। এই নামাজকে ‘সালাতুল লাইল’ বা ‘কিয়ামুল লাইল’ নামাজও বলা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোৎকৃষ্ট আমল। এ সময় আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দার ফরিয়াদ শোনেন।
ইশরাক
‘ইশরাক’ অর্থ হলো উদয় হওয়া বা আলোকিত হওয়া। শরিয়তের পরিভাষায় ইশরাক হলো সূর্যোদয়ের পর যখন পূর্ণ কিরণ বিচ্ছুরিত হয়, সে সময়। এই সময়ের নামাজকে ইশরাক নামাজ বলা হয়। হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সঙ্গে আদায় করবে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে রত থাকবে; অতঃপর দুই রাকাত সালাত আদায় করবে, তবে সে একটি হজ ও একটি ওমরাহর সওয়াব লাভ করবে। পরিপূর্ণ! পরিপূর্ণ! পরিপূর্ণ! অর্থাৎ একটি হজ ও একটি ওমরাহর পরিপূর্ণ সওয়াব লাভ করবে। (তিরমিজি: ৫৮৬)। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন; এরপর সূর্য ওপরে উঠলে তিনি (ইশরাকের) নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ: ১২৯৪)।
মুফতি আমিমুল ইহসান (রা.)-এর মতে, সাধারণত সূর্যোদয়ের ২৩ মিনিট পর ইশরাকের ওয়াক্ত শুরু হয়। কারও মতে, সূর্যোদয়ের ২৫ বা ৩০ মিনিট পর থেকে এর সময় আরম্ভ হয়। শায়খ ইসাইমিনের মতে, সূর্যোদয়ের ১৫ মিনিট পর ইশরাক আরম্ভ হয়। আধুনিক গবেষণায় সূর্যোদয়ের পাঁচ থেকে আট মিনিট পরই ইশরাকের সময় হয়। সকাল নয়টা পর্যন্ত এই নামাজ আদায় করা যায়।
চাশত
‘চাশত’ অর্থ হলো দিনের দ্বিতীয় প্রহর, মধ্যাহ্ন–পূর্ব বা মধ্য–পূর্বাহ্ন। চাশত শব্দটি ফারসি, এর আরবি প্রতিশব্দ হলো দোহা বা জোহা; উচ্চারণে এটি দুহা বা জুহা হয়ে থাকে। কোরআনে এই (দোহা বা জোহা) নামে একটি সূরাও রয়েছে। যার শুরুতে বলা হয়েছে: শপথ পূর্বাহ্নের! (৯৩: ১)। এই সময়কে ওয়াক্তুজ জুহা বা চাশতের ওয়াক্ত বলা হয়। চাশত নামাজ ৮ থেকে ১২ রাকাত পড়া ভালো; তবে চার রাকাত বা দুই রাকাত পড়লেও চাশত নামাজ বলেই গণ্য হবে।
জাওয়াল
‘জাওয়াল’ অর্থ হলো স্থানান্তর, স্থানচ্যুতি, পরিবর্তন, আবর্তন, সরে যাওয়া ও হেলে যাওয়া ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় জাওয়াল হলো দিনের তৃতীয় প্রহরের প্রারম্ভ, মধ্যাহ্নোত্তর, অপরাহ্ণের সূচনা সময়; দিনের মধ্যভাগে বা দুপুরে সূর্য যখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে যায়। এই সময়কে ওয়াক্তুজ জাওয়াল বলা হয়। এটি মূলত মধ্যদিনের সিজদা ও নামাজ নিষিদ্ধ সময়ের পর জোহরের ওয়াক্তের সূচনাপর্ব। এ সময় যে নফল নামাজ আদায় করা হয়, তাকে জাওয়ালের নামাজ বলা হয়।
হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সর্বদা সূর্য ঢলে পড়ার পর চার রাকাত নামাজ আদায় করতেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি সদা সূর্য হেলে পড়লে চার রাকাত নামাজ কেন আদায় করেন? তিনি (সা.) বললেন, সূর্য ঢলে পড়লে আসমানের দরজা খোলা হয়, এরপর জোহর নামাজ পর্যন্ত তা বন্ধ করা হয় না। আমি চাই, ওই সময়ে আমার কোনো নেক আমল ওপরে যাক। (ইবনু মাজাহ: ১১৫৭)। জাওয়াল নামাজ চার রাকাত, দুই রাকাত পড়লেও তা নামাজরূপে পরিগণিত হয়।
আউওয়াবিন
‘আউওয়াবিন’ আরবি শব্দ। এটি বহুবচন; অর্থ হলো প্রত্যাবর্তনকারীরা। কর্মবাচ্য বা কর্মকারক ও সম্বন্ধ পদ হিসেবে হয় ‘আউওয়াবিন’, কর্তাবাচক ও কর্তৃকারক হিসেবে মূল রূপ হলো ‘আউওয়াবুন’। এর একবচন হলো আউওয়াব, যার মানে হলো প্রত্যাবর্তনকারী। যিনি আল্লাহর দিকে বেশি বেশি ফিরে আসেন, গুনাহ থেকে বেশি পরিমাণে তওবা করেন। ‘আউওয়াব’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে চারবার এসেছে। ‘আউওয়াব’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘অত্যধিক অনুগত’, যিনি একান্তে গোপনে নির্জনে নিজের পাপ স্মরণ করে তার জন্য তওবা করে আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে যান। ‘আউওয়াব’ শব্দটি ‘মুসাব্বিহ’ বা তাসবিহ পাঠকারী তথা পবিত্রতা বর্ণনাকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কখনো এটি ‘দৃঢ় সংকল্প’ ও ‘অবিচল’ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার ‘সন্ধ্যা সমীরণ’ অর্থেও এর ব্যবহার রয়েছে। আরবদের মধ্যে ‘আবাতিশ শামস’ কথাটি ‘গাবাতিশ শামস’ অর্থে ব্যবহৃত হয়; ‘গারাবাতিশ শামস’ মানে সূর্য অস্তমিত হলো বা সূর্য অস্ত গেল।
শরিয়তের পরিভাষায় ‘আউওয়াবিন নামাজ’ হলো মাগরিবের নামাজর পর এশার নামাজের আগে আদায় করা নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ছয় রাকাত নামাজ আদায় করবে; এসবের মাঝে কোনো মন্দ কথা না বলে, তার এই নামাজ ১২ বছরের ইবাদতের সমতুল্য গণ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ২০ রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। (তিরমিজি, মিশকাত; ১০৩-১০৪; ফয়জুল কালাম, পৃষ্ঠা: ৩২০-৩২১, হাদিস: ৪৪৯-৪৫০)।
‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়তেন এবং তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়বে, তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে; যদি তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণও হয়।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই নামাজকে আউওয়াবিন নামে অভিহিত করেছেন। ইমাম তীবি (রা.)-এর মতে, মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নতও এই ছয় রাকাতের অন্তর্ভুক্ত। অবশিষ্ট রাকাতগুলো এক নিয়তে দুই বা চার রাকাত করে পড়া যায়। মাগরিবের পর সর্বোচ্চ ২০ রাকাত ও সর্বনিম্ন দুই রাকাত পড়ার কথা বর্ণিত আছে; চার রাকাত এবং ছয় রাকাতের বর্ণনাও পাওয়া যায়। যার পক্ষে যখন যা সম্ভব, তিনি তা-ই পড়বেন।
সূত্রঃ মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী