রোববার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চতুর্থ দিনে উইকেট পড়েছে ১৭টি। ২৩১ রানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ২১৩ রানে। ম্যাচ হেরেছে ১৭ রানে। এতে দুই ম্যাচ সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হলো মুমিনুল হকের দল। ২০১২ সালের পর এই প্রথম ঘরের মাঠে টেস্টে হোয়াইটওয়াশের তেতো অভিজ্ঞতা পেল বাংলাদেশ।
ক্যারিবিয়ানদের জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান শেষ ক্যাচটা যিনি নিলেন সেই কর্নওয়ালের। প্রথম ইনিংসে ৫ আর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৪ উইকেট। ম্যাচে ৯ উইকেট, সিরিজে ১৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬১.৩ ওভারের মধ্যে তিনি একাই করলেন ৩০ ওভার।
বিরামহীন বল করে গেছেন তিনি। উচ্চতার কারণে এমনিতেই বাড়তি বাউন্স পান, গতি তো আছেই। চতুর্থ দিনের এই উইকেটে হয়ে গেলেন আরও বিপদজনক। তাকে খেলার উত্তর খুঁজে পেল না বাংলাদেশ।
অবশ্য বাংলাদেশের বাধা হয়েছে অ্যাপ্রোচও। তামিম ইকবাল শুরু করেছিলেন দারুণ ইতিবাচক মেজাজে। তাতে দারুণ একটা শুরু মিলেছিল। দ্রুত তিন উইকেট পড়ার পর খেলার ধরণ ঠিক করতেই দ্বিধায় পড়ে যান ব্যাটসম্যানরা।
টার্ন-বাউন্সে রূপ নেওয়া উইকেটে টিকে থাকা সহজ ছিল না। মেরে খেলার চিন্তা তাই ভুল ছিল না। কিন্তু প্রয়োগে থাকল খামতি। মারা আর ধরার ভারসাম্য, ইতিবাচক থাকা আর তেড়েফুঁড়ে মারার তফাৎ ধরতে না পারার রোগে আরও একবার ভুগল বাংলাদেশ।
অথচ দিনের শুরুটা হয়েছিল নিজেদের একদম চিন্তামতো। আগের দিন ৩ উইকেটে ৪০ রান নিয়ে শুরু করে উইন্ডিজ আর কেবল ৭৭ রান যোগ করতে পেরেছিল। আবু জায়েদ রাহির স্যুয়িং, তাইজুল ইসলামের টার্ন-বাউন্সে ১১৭ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল তারা।
উইকেট বিবেচনায় সহজ না হলেও প্রথম ইনিংসে বড় ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের সামনে বড় সুযোগ তৈরি হয়েছিল ম্যাচ জেতার।
রান তাড়ায় এসব উইকেটে অ্যাপ্রোচ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধরে খেলে লম্বা সময় টিকে থাকা মুশকিল। তামিম সেটা বুঝেই হয়ত নিয়েছিলেন ইতিবাচক ধরণ। একশোর উপর স্ট্রাইকরেট বলেছে প্রয়োজনের চেয়েও একটু বেশি ইতিবাচক দেখা গেছে তাকে।
সৌম্যকে এক পাশে রেখে তামিম দ্রুত বাড়াতে থাকেন রান। দুই পেসার আলজেরি জোসেফ, শ্যানন গ্যব্রিয়েল আর স্পিনার জোমেল ওয়ারিকন দিয়েছেন প্রচুর আলগা বল। যার ফল তুলে বাংলাদেশকে উড়ন্ত শুরু পাইয়ে দেন তামিম। প্রথম ১২ ওভারে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৫৯!
এক পাশে কর্নওয়ালকে রেখে তাই অধিনায়ক ব্র্যাথওয়েট নিজেই বল হাতে নেন। সেই ফাটকাই কাজে লাগে তার। ১৩তম ওভারে নিতে এসেই নেন উইকেট। সৌম্য কাট করতে গিয়েছিলেন। আউটসাইড এজ হয়ে বল কিপারের গ্ল্যাভসে লেগে যায় স্লিপ ফিল্ডারের হাতে। রিভিউ নিয়ে তাকে ফেরার পথ দেখায় উইন্ডিজ।
টেস্টে ৭ ইনিংস ও দুই বছর পর ফিফটি পাওয়া তামিম এরপরই শেষ। শর্ট মিড অফের হাতে যায় তার লফটেড ড্রাইভ। ৪৬ বলে ৯ চারে ৫০ করে যান তিনি।
তিনে নেমে পুরো সিরিজে ব্যর্থ নাজমুল হোসেন শান্ত ফেরাতে পারেননি ছন্দ। চা-বিরতির ঠিক আগে শর্ট লেগে যায় তার ক্যাচ। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারি কর্নওয়াল তাকে আউট করেই খুলেন উইকেটের খাতা।
চা-বিরতির পর নেমে বেশ কিছুটা সময় ক্রিজে মুশফিকুর রহিম। মুমিনুল হকের সঙ্গে মিলে মূল কাজটা করার দায়িত্ব ছিল তার। ২৩ রানের একটা জুটির পর ভেঙ্গে যায় এই জুটিও। প্রথম দুই ওভারে সাদামাটা বল করে মার খাওয়া জোমেল ওয়ারিকন পরের স্পেলে ফিরেই দেখান ঝলক। তার দারুণ ডেলিভারি মুশফিকের ব্যাটের কানা ছোঁয়ে আশ্রয় নেই কিপারের গ্লাভসে। এজ হলেও রিভিউ নষ্ট করে ফেরেন ১৪ রান করা মুশফিক।
খানিক পর নেই মোহাম্মদ মিঠুন। কর্নওয়ালের বাড়তি বাউন্সের বল সরাতে গিয়ে ক্যাচ দেন লেগ স্লিপে। বিনা উইকেটে ৫৯ থেকে ১১৫ রানে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে ৫ উইকেট।
এক পাশে উইকেট পতনের মিছিলে টিকে ছিলেন অধিনায়ক মুমিনুল। প্রথম ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার লিটনের সঙ্গে জমে উঠে তার বেশ ভালো জুটি। জেতার জন্য প্রয়োজনীয় রান তিন অঙ্কের নিচে নামিয়ে আনে বাংলাদেশ।
ওয়ারিকন এসে থামিয়ে দেন মুমিনুলের দৌড়। বলটা ঠেকাতে গিয়ে ব্ল্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে ধরা দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশ অধিনায়কের ২৬ রানের ইনিংস। ১৪৭ রানে ৬ষ্ঠ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
লিটন থিতু হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই উইকেটে থিতু হওয়া যেন পাকাপোক্ত কোন ব্যাপার নয়। অবশ্য যে শটে লিটন কাটা পড়লেন তাতে উইকেটেরই দায় কতটা। কর্নওয়ালের জোরের উপর করা বল কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে দেন ক্যাচ।
তাইজুল ইসলাম এসে ২৫ বল টিকেছিলেন। তাতে খেলার আয়ু একটু লম্বা হয়েছে- এই যা। কর্নওয়ালের সোজা বলেই হয়েছেন এলবিডব্লিউ। নাঈমকে ফিরিয়ে তৃতীয় উইকেট শিকার করেন ব্র্যাথওয়েট।
এরপরই মিরাজের ওই ব্যাটিং। কর্নওয়ালকে লং অন আর মিড উইকেট দিয়ে ছক্কায় উড়ান। পুল, রিভার্স সুইপে আসে চার। শেষ বিকেলে রোমাঞ্চ তখন তুঙ্গে। আবু জায়েদ বল ঠেকিয়েও বাড়ান আশা। তবে মিরাজই হয়েছেন কাবু। ওয়ারিকনের বল তার ব্যাট ছুঁয়ে যায় স্লিপে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ ক্যাচ লুফে ইতি টানেন তুমুল লড়াইয়ের এক সিরিজের।
তবে বাংলাদেশের জন্য সিরিজটি হয়ে থাকল চরম হতাশার। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম পয়েন্টের আশা নিয়ে নেমে থাকতে হলো খালি হাতে। পয়েন্ট পাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি নিয়ে টেস্টে নামা দরকার। বাংলাদেশের ছিল না তা। দীর্ঘ এক বছর টেস্ট না খেলার সঙ্গে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে লম্বা বিরতি। সিরিজের আগে কোন প্রস্তুতি ম্যাচ ছাড়াই নেমে যাওয়ায় অনেকগুলো প্রশ্ন দেশের ক্রিকেটকে আগামী কয়েকদিন করবে বিদ্ধ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস: ৪০৯
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ২৯৬
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস: ৫২.৫ ওভারে ১১৭ (ব্র্যাথওয়েট ৬, ক্যাম্পবেল ১৮, মোসলি ৭, বনার ৩৮, ওয়ারিকান ২, মেয়ার্স ৬, ব্ল্যাকউড ৮, জশুয়া ২০, আলজেরি ৯, কর্নওয়াল ১, গ্যাব্রিয়েল ১* ; তাইজুল ২/৩৬, নাঈম ৩/৩৪, মিরাজ ১/১৫, জায়েদ ২/৩২ )।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: ৬১.৩ ওভারে ২১৩ (লক্ষ্য ২৩১) (তামিম ৫০, সৌম্য ১৩, শান্ত ১১, মুমিনুল ২৬, মুশফিক ১৪, মিঠুন ১০, লিটন ২২, মিরাজ ৩১, তাইজুল ৮, নাঈম ১৪, জায়েদ ০ ; কর্নওয়াল ৪/১০৫, আলজেরি ০/১৬, গ্যাব্রিয়েল ০/৮, ওয়ারিকন ৩/৪৭ , ব্র্যাথওয়েট ৩/২৫ )
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৭ রানে জয়ী।
সিরিজ: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২-০ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: রাহকিম কর্নওয়াল।